Description
বাংলা উপন্যাসের জগতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আগমন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলেছেন, শরৎচন্দ্রের আকস্মিক আবির্ভাবের কথা সেকালের পাঠকসমাজের মনে পড়বে। যখন একদিকে রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের বিচিত্র ঐশ্বর্য ও সূক্ষ্ম তাৎপর্য এবং প্রভাতকুমারের রচনার প্রসন্ন মাধুর্য নিয়ে পাঠক সমাজ নিজ নিজ প্রকৃতি ও প্রবণতা অনুসারে খুশি হয়েছিলেন, তখন তারা বুঝতে পারেননি কোন গগনে, কোন বনান্তরালে ঔষধিনাথ চন্দ্রের উদয় হয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্যে অপরাজেয় কথা-সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)। তাঁর সরব পদচারণায় বাংলা উপন্যাস জনপ্রিয়তার শিখরে পৌছে। বাংলা উপন্যাসের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চোখের বালি উপন্যাস ও নষ্টনীড় গল্প প্রভৃতিতে যে সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই রীতির বিকাশ ঘটালেন। বাংলা সাহিত্যে তার আবির্ভাব আকস্মিকতায় এবং অতুলনীয় লেখনী নির্মাণের দ্বারা স্বল্প সময়ে বাংলা সাহিত্য জগতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছালেন তিনি। নিষিদ্ধ সমাজ বহির্ভূত প্রেমানুভূতির বিশ্লেষণে তিনি যে অপরিসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে তিনি বাঙালি সুলভ সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি অতিক্রম করে আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ সাধন করলেন।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাস যখন প্রথম দিকে প্রকাশিত হলো তখন তার প্রভাবে তথাকথিত ভদ্র সমাজ যেন শিউরে উঠেছিল। অনেকে তাদের বাড়ির মেয়েদের তার বই পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু শরৎচন্দ্রের মত বাংলার জন-জীবনকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে আর কোনও সাহিত্যিক পারেননি তা বোধহয় নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করে আমাদের মুক্তিচেতনাকে আলোকিত করে তুললেন বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মননশীলতা, রূপক ও অলঙ্করণ প্রবণতা এবং সূক্ষ্ম ভাবপরিক্রমতার ফলে তার সাহিত্য প্রত্যক্ষ ও প্রবলভাবে সমাজসত্তাকে আঘাত করতে পারেনি। কিন্তু শরৎচন্দ্র সোজাভাবে, স্পষ্ট ভাষায় ও দুঃখ-বেদনার কারুণ্যে সিক্ত করে সমাজের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরলেন এবং আমাদের প্রচলিত সংস্কার, নীতিবোধ ও ধর্মবোধের অন্যায় ও জবরদস্তি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। এর ফলে আমাদের বদ্ধ অচলায়তনের দ্বার যেন হঠাৎ খুলে গেল এবং সেই মুক্ত দ্বার দিয়ে আলো-বাতাস এসে মুক্তির আনন্দে চঞ্চল করে তুলল আমাদের। নারীর সতীত্বের যে ধারণা এতদিন আমাদের মনে বদ্ধমূল ছিল তা বিচলিত করে তুলল । উপেক্ষিত ও অবজ্ঞাত মানুষ সম্বন্ধে এক নতুন মূল্য ও মর্যাদাবোধ আমাদের মনে জাগ্রত হলো। দরিদ্র ও দুর্গত কৃষক ও শ্রমিক সমাজের মধ্যে তিনি বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দিলেন। শরৎচন্দ্রের পরবর্তীকালে যে সমাজ-প্রগতি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলন দেখা দিয়েছিল তার মূলে যে শরতসাহিত্যের প্রেরণা অনেকখানি ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
Reviews
There are no reviews yet.