আমরা সবাই রাজা মিডাস এর গল্পটা জানি। মিডাস চেয়েছিলো পৃথীবিটাকে স্বর্ণ দিয়ে মুড়ে দিতে। সে হাত দিয়ে যা স্পর্শ করত তাই সোনা হয়ে যেত। একসময় সে খেয়াল করল সে কিছু খেতে পারছে না, সব খাবার হাত দিয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথে সোনা হয়ে যাচ্ছে! এমনকি তার মেয়েও তাকে স্পর্শ করা মাত্রই সোনা হয়ে গেলো! এমন কিছু আমরা আশা করি, যেটা পাওয়ার পরে পৃথীবি টা তেমনভাবে বদলে যায় যেমনটা আমরা কখনো চাই না।
আজ ঠিক তেমনই এক সোনার অভিশাপে আক্রান্ত হয়েছি আমরা। আমাদের বাসভূমি এই পৃথীবিকে অনেক বেশি উন্নত করে তুলতে আমরা আবিষ্কার করলাম প্লাস্টিক। সভ্যতার অসাধারন আবিষ্কার এই প্লাস্টিক। প্লাস্টিক জীবন বদলে দিলো। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নানা ভাবে নানা চেহারায় প্লাস্টিকের ব্যাবহার।
দাঁত মাজার ব্রাশ, চুল আচরাবার চিরুনি, ভাত খাবার থালা, আসবাব পত্র, গাড়ি-ঘোড়া সব জাগায় নানারকম চেহারায় এই প্লাস্টিক বা সিন্থেটিক পলিমার উপস্থিত! ব্যাকেলাইট, পলিথিন, পিভিসি, নাইলন কতরকম তার চেহারা আর কতো ব্যাপক তার ব্যাবহার। এমনকি আমাদের জামা-কাপড়ও প্লাস্টিক (সিন্থেটিক পলিমারের মাইক্রো ফাইবার দিয়ে তৈরি সিন্থেটিক কাপড়)।
মজার বিষয় টা হচ্ছে, এই সব প্লাস্টিকের দ্রব্যগুলো আমরা স্থায়ীভাবে ব্যাবহার করি না। প্রতিটা প্লাস্টিকের দ্রব্য ব্যাবহারের পর ফেলে দিই, নতুন আরেকটা নিয়ে আসি। নতুন প্লাস্টিকের উৎপাদন তো আর থেমে নেই!
কিন্তু একটা কথা কখনো ভাবি না, যেটা ফেলে দেই সেটা কোথায় যায়?
প্লাস্টিক প্রকৃতিতে মিশে যেতে প্রায় ৫০০-১০০০ বছর সময় নেয়। এইরকম একটা সুপার টাফ জিনিসকে একবার ব্যবহার করে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকি আমরা! অর্থাৎ আজ পর্যন্ত যত প্লাস্টিক তৈরি হয়েছে, সব রয়ে গেছে পরিবেশে। আর আমরা সমানে প্লাস্টিক বানাচ্ছি, ব্যবহার করছি, ফেলে দিচ্ছি, আরো বানাচ্ছি। তার মধ্যে ৯% রিসাইকেল করা হয়, ১২% পোড়ানো হয় আর বাকিটা থেকে যায়।
এর মানে আজ পর্যন্ত আমি যতগুলো কলম কালি শেষ হওয়ার পর ফেলে দিয়েছি, যতগুলো চুলের ক্লিপ ব্যাবহার করে ফেলে দিয়েছি, যতো কসমেটিক্সের প্যাকেজিং ফেলে দিয়েছি, সে সব কিছু রয়ে গেছে।
আজকে পৃথীবিতে ৬.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টন ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক জমা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগটা সাগরে গিয়ে জমা হয়। করুন ভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান। মারা যাচ্ছে অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণী। আমরা কল্পনাও করতে পারছি না, ব্যাপারটা কতো ভয়ানক ভাবে বুমেরাং হয়ে আমাদের দিকে ফিরে আসবে।
প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন টন করে প্লাস্টিক জমা হচ্ছে সমুদ্রে। এখানেই শেষ না। আমাদের ব্যাবহারের পণ্য ছাড়াও অযস্র প্লাস্টিক আছে পরিবেশে যেগুলো খালি চোখে আমরা দেখি না। অত্যন্ত সূক্ষ মাইক্রো প্লাস্টিক BPA ব্যাবহার করা হয় প্লাস্টিকের বোতল কে স্বচ্ছ (transparent) করতে, DEHP প্লাস্টিকের বোতল কে নমনীয় (flexible) করতে। এছাড়াও হাজারো মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া গেছে আমাদের খাবারে, কাপড় ধোয়া পানিতে, প্রসাধনীতে, সামুদ্রিক লবণে আর ঘর বাড়ির ধুলো ময়লাতে। হ্যা, আমাদের শরীরে ধুকতেও বাকি নেই। ৯০% মানুষের মূত্রে BPA পাওয়া গেছে।
প্রতি বছর ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রো প্লাস্টিক সমুদ্রে জমা হচ্ছে। প্ল্যাংক্টন খাওয়া প্রানীরা এখন খাচ্ছে প্লাস্টিক। তাদের পরিপাক তন্ত্রের মাধ্যমে প্লাস্টিকের মাইক্রো ফাইবারগুলো আরো অনেক বেশি সূক্ষ আকার নিয়ে পরিবেশে ফিরে আসছে। এই দূষনের প্রভাব তো কল্পনা করতেও ভয় লাগে।
এক্ষুনি সচেতন না হলে মিডাসের গল্পের মতো পৃথীবিটা হয়তো তেমন হয়ে যেতে পারে যেমনটা আমরা কোনদিনও চাই না। এই সমস্যা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। প্লাস্টিকের ব্যাবহার কম করতে চলুন নিজে উদ্যোগ নেই এবং অন্যকে উৎসাহিত করি।
You must be logged in to post a comment.