এখন থেকে ২১ কোটি বছর আগে মেসোজয়িক মহাযুগে পৃথিবীতে ডাইনোসরের আবির্ভাব ঘটেছিল। বিশাল দেহের ভয়ানক এই প্রণীরা পরবর্তী ১৫ কোটি বছর ধরে মহা প্রতাপের সাথে রাজত্ব করেছিল পৃথিবীতে। কিন্তু তাদের সেই রাজত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। আজকের পৃথিবীতে মাটির নিচে, শিলাস্তরে বা বরফের আস্তরণের নিচে প্রস্তরিভূত অবস্থায় সেই দৈত্যদের দেহাবশিষ্ট পাওয়া যায়।

ডাইনোরের বিলুপ্তির কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রকম মতামত দিয়েছেন। তবে ডাইনোসরদের সত্যি দূর্ভাগ্য যে প্রতিকূল পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর তাদের নিজস্ব অক্ষমতা সব একযোগে পৃথিবী থেকে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিত ভূমিকা রেখেছিল।

মেসোজয়িক মহাযুগের শেষ দিকে পৃথিবীর জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তন হতে শুরু করে। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে প্রানীদের মধ্যে অভিযোজনিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। পরিবর্তিত আবহাওয়ার সাথে টিকে থাকতে উদ্ভিদ ও প্রাণিকূল নানাভাবে অভিযোজিত হয়। কিন্তু ডাইনোসরদের দুর্ভাগ্য তারা সময়ের সাথে সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে ব্যার্থ হয়।

ডাইনোসর বিলুপ্ত হবার ঘটনা থেকে পরিষ্কার ভাবে বুঝা যায়, শারিরীক ভাবে শক্তিশালী, প্রতাপশালী, বিশাল দেহের অধিকারী এবং ভয়ংকর আর হিংস্র হলেই টিকে থাকা যায় না। টিকে থাকতে গেলে হতে হয় নমনীয় আর পরিবর্তনশীল।

ডাইনোসর বিলুপ্তির জন্য তাদের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে দায়ী। প্রথমত, তারা দলবদ্ধ হয়ে বাস করতো। ডাইনোসরের অধিকাংশ প্রজাতি ছিল হিংস্র। তারা আলাদা আলাদা হয়ে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রতযোগিতায় থাকতো। ফলে নিজেদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বিগ্রহ চলতো সবসময়। একসাথে না চলার এই বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের অনেক বড় এক দুর্বলতা।

প্রায় প্রতিটি ডাইনোসর আকার ও আকৃততে ছিল অনেক বড়। বিশাল ভারী দেহের কারণে তারা দ্রুত চলাফেরা করতে পারত না। এর ফলে বিপদ বা শত্রুর হাত থেকে আত্বরক্ষা ছিল অনেক কঠিন।

দেহাকৃতি বিরাট হলেও এদের মাথা ও মস্তিষ্ক ছিল সেই তুলনায় অনেক ছোট এবং অনুন্নত। অনুন্নত মস্তিষ্কের কারণে ডাইনোসর বুদ্ধিমান বা চতুর ছিল না। তাদের পিটুইটারি গ্রন্থির সক্রিয়তাও ছিল কম। তাই পর্যাপ্ত হরমোন নিসৃত না হওয়ায় ডাইনোসরের মানসিক বকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।

ডাইনোসরের প্রজনন প্রক্রিয়া সহজ ছিল না। ডিমের খোলক ছিল অত্যধিক পুরু। এর ফলে খুব সহজে খোলক ভেঙ্গে বাচ্চা বেড়িয়ে আসতে পারত না৷ বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে বিলুপ্তির প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে থাকে।

Triassic যুগে ডিম্বজ স্তন্যপায়ীদের আবির্ভাব ঘটে। এই স্তন্যপায়ী প্রানীরা ছিল অনেক চতুর ও বুদ্ধিমান। এরা খুব সহজেই ডাইনোসরের খাদ্য ও বসতিতে ভাগ বসাতে সক্ষম হয়েছিল। এমন অসম প্রতিযোগিতায় ডাইনোসর পরজিত হয়।

“দ্যা ল্যান্ড বিফোরটাইম” এনিমেশন মুভিতে দেখা যায় ডাইনোসরের বিলুপ্তির সময়কার চিত্র। প্লেইস্টোসীন যুগের হিমবাহ, বরফাচ্ছাদিত পৃথিবী আর প্রচন্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বেচে থাকার জন্য করুন সংগ্রাম করতে থাকে ডাইনোসরের কয়েকটি বাচ্চা। তার উপর অন্য প্রজাতির ডাইনোসরদের আক্রমণ, শত্রুতা, সবমিলিয়ে লোমহর্ষক এক কাহিনি। মেসোজয়িক মহাযুগের শেষে ডাইনোসরের বিলুপ্ত হওয়ার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এনিমেশনটিতে।

ডাইনোসরের উৎপত্তির সময় পৃথিবীর জলবায়ু ছিল উষ্ণ এবং আর্দ্র, ডাইনোসরের জীবন ধারণের জন্য খুবই উপযোগী। কিন্তু মেসোজয়িক মহাযুগের শেষভাগে জলবায়ু হঠাৎ পরিবর্তন হতে শুরু করে। পৃথিবীর তাপমাত্রা খুব দ্রুত শীতল হয়ে আসে। এই শীতল ও শুষ্ক পরিবেশ ডাইনোসরের টিকে থাকার উপযোগী ছিল না। ডাইনোসর উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রানী। ঠান্ডা প্রতিরোধের জন্য তাদের দেহে কোনোরকম লোম বা পালক ছিল না। প্রবল ঠান্ডার কবলে পরে মারা যেতে থাকে তারা।

আবহাওয়ার শুষ্কতার কারণে cretaceous যুগে স্থলভাগ ক্রমশ উঁচু হতে থাকে। এর ফলে দ্রুত হারে কমতে থাকে জলাভূমি এবং জলাশয়। তারপর সমুদ্রের পানি জমে যেতে শুরু করে। বিপুল সংখ্যক জলজ ডাইনোসর প্রজাতি তাদের আবাসস্থল হারায়।

পৃথিবীতে পরিবর্তিত পরিবেশে নতুন ধরনের উদ্ভিদরাজির সৃষ্টি হয়েছিল। এসব নতুন উদ্ভিদ তৃণভোজী ডাইনোসরদের গ্রহণ উপযোগি ছিল না। খাদ্যাভ্যাস বদলাতে ব্যর্থ হওয়ায় খাদ্যের অভাবে উদ্ভিদভোজী ডাইনোসররা মারা যেতে থাকে। এর প্রভাবে মাংসাশী ডাইনোসরেরাও বিলুপ্তির মুখে পড়ে।

অনেক বিজ্ঞানীর মতে, সে সময় উদ্ভিদের মধ্যে আ্যালকালয়েড (alkaloid) উপস্তিত ছিল। ডাইনোসররা যেসব উদ্ভিদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতো তাতেও ছিল বিষাক্ত আ্যলকালয়েড। ফলে দেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। আবার বিষাক্ত মৃতদেহ খাওয়ার ফলে অনেক মাংসাশী ডাইনোসরও প্রাণ হারায়।

ভূতত্ববিদরা মনে করেন, cretaceous যুগের শেষে, অর্থাৎ ৬ কোটি বছর আগে এক বিশাল উল্কাপিণ্ড মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে পতিত হয়েছিল। এর প্রভাবে সমগ্র পৃথিবী ধুলার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে। ধুলার কারণে দীর্ঘসময় ভূপৃষ্ঠে সূর্যালোক এসে পৌঁছাতে পারে নি। পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং হিমশীতল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ডাইনোসররা এই পরিবেশ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়।

পরিবেশ দূষণ ও জীবাণুর সংক্রমণে নানা রোগের সৃষ্টি হতে থাকে। কোনো কোনো রোগ মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করে এবং প্রচুর সংখ্যক ডাইনোসর মারা যায়।

এ সকল ঘটনার প্রভাবে এক সময় পৃথিবী জুরে আধিপত্য করা এই প্রাণীরা ৬ কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।