উনবিংশ শতকে যুক্তরাজ্য বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও ক্ষমতাশালী দেশ, সারা বিশ্বে তাদের কলোনি। কিন্তু এরপরেও দেশটির রাজধানী লন্ডনে ছিল ঢাকা শহরের মতো বস্তি এবং সেসব বস্তিতে মানুষ খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করত। আমি লেখাটি সরাসরি ইংরেজি থেকে বাংলাতে অনুবাদ করেছি।

চার পেনির কফিন:

এই যে ছবিতে দেখছেন যে কতগুলো লোক বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছে। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এরা কফিনে শুয়ে আছে। কিন্তু আসলে তা নয়। লন্ডনে তখন অনেক গৃহহীন মানুষ থাকত। ঠিক যেরকম ঢাকা শহরের বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার দরিদ্র মানুষরা আসে কাজের খোঁজে এবং এদের অনেকের ঘর নেই।  রেলওয়ে স্টেশন, ফুটপাতে এরা রাত কাটায়। লন্ডনেও তখন এই অবস্থা বিরাজ করছিল। তখন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান এসব দরিদ্র লোকদের সহায়তায় এগিয়ে আসে কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। তখন এসব মানুষদের সম্বল ছিল এই চার পেনির কফিন।  পুরানো গুদামঘরে এমন বাক্স আকারের বিছানা থাকত সারি সারি। গরীব মানুষ চার পেনিতে এগুলো ভাড়া করে থাকত। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই কফিন বিছানা গরীব লোকদের জন্যে ছিল বিলাসিতা। কারণ মাত্র একপেনি দিয়ে একজন গরীব মানুষ সারারাতের জন্যে চেয়ার ভাড়া করতে পারত কিন্তু চেয়ারে ঘুমাতে গেলে এর দ্বিগুণ দাম দিতে হোত। এই কারণে অনেক গৃহহীন মানুষ ওয়ার্কহাউজে থাকত। দরিদ্র, গৃহহীন, শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, এতিম শিশু, বয়স্ক মানুষ, অবিবাহিত মহিলারা এই ওয়ার্কহাউজে থাকত। এই ওয়ার্কহাউজের পরিবেশ মোটেও ভাল নয়। চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্ট উপন্যাসের নায়ক অলিভার এমনি একটি ওয়ার্কহাউজে জন্ম নেয় ও বড় হয়।

যে নর্দমার পানিতে নোংরা ফেলা হতো আবার সেই পানিই পানের জন্যে এবং গোসলের জন্যে ব্যবহৃত হোত:

১৮৪৯ সালে সাংবাদিক হেনরি মে হিউ (Henry Mayhew)  দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের বার্মন্ডসে (Bermondsey) জেলার উপরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন যা পাঠকদের যুগপৎ হতবাক এবং ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই জেলা ‘কলেরা জেলা’ নামে পরিচিত ছিল। তো মে হিউ তার রিপোর্টে বলেন যে  এই বস্তির মূল রাস্তা মধ্যে দিয়ে একটি খোলা নর্দমা চলে গিয়েছে। এই নর্দমায় এই বস্তির লোকেরা বালতিতে করে তাদের মলমূত্র এবং অন্যান্য নোংরা ফেলছে। আবার একই সাথে এই নর্দমার পানি দিয়ে বাচ্চারা গোসল করছে এবং সেই পানি পান করছে। নর্দমা থেকে বালতিতে পানি নেবার পরে তারা সেই বালতিটা কয়েকদিন রেখে দিত। এতে করে বালতির উপরেভাগে যত ময়লা সব জমা হোত। এরপরে তারা সেই ময়লা ফেলে দিয়ে পরিস্কার পানিটুকু পান করত এবং গোসল করত।

বস্তিবাসীরা মোটেও অলস ছিল না বরং যে কোনভাবে দুটো অর্থ আয় করার জন্যে তারা সব সময়ে সচেষ্ট ছিল:

লন্ডনের তৎকালীন শিক্ষিত সমাজের চিন্তা ছিল বস্তিবাসীর অলস, লম্পট, চরিত্রহীন। তাদের নিজেদের স্বভাব তাদের দারিদ্র্যের জন্যে দায়ী। কিন্তু বাস্তব মোটেও তা ছিল না। হ্যা, অনেক গরীব লোক ঠিকমতো কাজ করত না। কিন্তু এসব বস্তিতে সাত বছর বয়স থেকেই বাচ্চারা কাজে লেগে যেত। ১৩ বছর হবার পরে মেয়েরা লন্ডনের ব্রায়ান্ট অ্যান্ড মে ম্যাচ ওয়ার্ক্স (Bryant & May Matchworks) ম্যাচ ফ্যাকটরিতে কাজ করত।

ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে লন্ডনের প্রচুর বয়স্ক মহিলা এবং অল্প বয়স্ক মেয়েরা ম্যাচ ফ্যাকটরিতে কাজ করত। এরা বস্তি থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কাজে আসত। বিরতিহীন ১৪ ঘন্টা কাজ করতে হোত। এমনকি একটু বিশ্রাম নিলে বা বাথরুমে গেলেও বেতন কাটা হোত। ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে তাদের কাজ ছিল জটিল এবং বিপদজনক। কারণ তারা বিষাক্ত শ্বেত ফসফরাস নিয়ে কাজ করত। সেই তুলনায় বেতন ছিল সামান্য। কারখানার মালিকরা একরকম ক্রীতদাসের মতোই তাদের খাটাত। জুলাই ১৮৮৮ সালে ব্রায়ান্ট অ্যান্ড মে ম্যাচ ওয়ার্ক্স এর শ্রমিকরা উপযুক্ত ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধার জন্যে ধর্মঘট করে এবং তাদের এই ধর্মঘটের ফলে মালিকপক্ষ বাধ্য হয়ে তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়। পূর্ণবয়স্ক নারী থেকে শুরু করে ১৩ বছর বয়সী মেয়ে শ্রমিকরা এই ধর্মঘটে অংশ নেয়। ব্রিটেনে শ্রমিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পুরোধা হচ্ছে এই ম্যাচ ফ্যাকটরির নারী শ্রমিকরা।

চিমনি ও রাস্তা পরিস্কার:

বস্তির লোকরা নানা ধরণের কায়িক শ্রম যেমন নির্মাণ শ্রমিক বা বন্দরে বিভিন্ন ধরণের কাজ করত। আর যারা অল্পবয়স্ক, দূর্বল, তারা বাঁচার তাগিদে হয় রাস্তা পরিস্কার করত নয়তো চিমনি পরিস্কার করত। ১৮৯০ এর দিকে লন্ডনে তিন লাখ ঘোড়া ছিল এবং এরা প্রতিদিন ১০০০ টন বিষ্ঠা উৎপাদন করত। এই বিশাল পরিমাণ বিষ্ঠা রাস্তায় পড়ে থেকে রাস্তা চলাফেরা করার অনুপযোগী হয়ে উঠত এবং প্রচন্ড দূর্গন্ধ ছড়াত। লন্ডনের সিটি কাউন্সিল ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী বাচ্চাদের দিয়ে এসব ঘোড়ার বিষ্ঠা পরিস্কার করাত। এটা খুবই বিপদজনক একটা কাজ ছিল কারণ ঘোড়াগাড়ী চালকরা এসব বাচ্চাদের মোটেও আমলে নিত না। তারা তাদের মতো গাড়ি চালিয়ে যেত।

আর বিত্তবানদের বাড়ির চিমনি পরিস্কার করা ছিল আরেক্টা কাজ। যদিও বাচ্চাদের শারিরীক নির্যাতন যাতে না করা হয় সেই ব্যাপারে আইন ছিল কিন্তু বিংশ শতাব্দির শেষ পর্যন্ত এই আইনের কঠোর প্রয়োগ ছিল না। ইস্ট এন্ডের বস্তিতে যেসব এতিম বাচ্চারা ছিল তাদের দিয়ে এই চিমনি পরিস্কার করান হতো। অনেক চিমনি ছিল আকারে ছোট। পূর্ণবয়স্ক মানুষের পক্ষে এসব চিমনি পরিস্কার করা সম্ভব ছিল না। এজন্যে এসব বাচ্চাদের দিয়ে চিমনিতে ঢুকিয়ে উপরে উঠিয়ে চিমনির গুড়ো কয়লা পরিস্কার করানো হতো। অনেক বাচ্চা ঐ চিমনির বদ্ধ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে ভয় পেত।  তারা তাদের মনিবদের মারধর করার মারের ভয়ে কাজ করত।  চিমনি পরিস্কার করতে গিয়ে গুড়ো কয়লায় নিশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে শিশু মারা যাবার ঘটনাও ঘটত।

মেয়েদের জন্যে পতিতাবৃত্তিই ছিল একমাত্র পেশা:

খুবই দুঃখদায়ক হলেও এটাই ছিল সত্যি। উনবিংশ শতাব্দিতে লন্ডনে মেয়েদের কাজের এত সুযোগ ছিল না। অনেক দরিদ্র কিশোরীরা ১২ বছর বয়স থেকেই পেটের দায়ে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিত। যদিও এরকম মেয়েদের সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না তবে ইতিহাসবিদদের মতে এই সংখ্যাটা ছিল ৮০ হাজারের আশেপাশে। অবশ্য কিছু কিছু মধ্যবিত্ত নারীরাও উচ্চ বিত্ত সমাজে দেহ বিক্রি করত কিন্তু বেশিরভাগ পতিতা ছিল দরিদ্র নারী। যারা এসব নারীদের নিয়ে জরিপ পরিচালনা করেন তারা দেখেন যে এদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে।

পূর্ব লন্ডনের বস্তিতে বসবাসকারী বেশিরভাগ মেয়েরা ১২ বছর বা তারও কম বয়সে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিত। এতিম মেয়েদেরকে জোর করে এই পেশায় আনা হতো। আর এসব নারীদের জীবন ছিল খুবই মর্মান্তিক। এদের নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং খুনও হতো। তবে সব দরিদ্র মহিলাই এই কাজ করতেন না। অনেক নারী কারখানায় কাজ করার পরে রাতের বেলায় আবার রাস্তায় কাজ করত একটু বেশি রোজগারের আশায়।

শিশু অপরাধী:

এটাও লন্ডনের বস্তির আরেকটি বৈশিষ্ট্য। চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্ট উপন্যাসে শিশু অপরাধীদের কথা বলা হয়েছে।  অলিভার টুইস্ট লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে এরকম একদল শিশু অপরাধীদের দলের সঙ্গে ভিড়ে যায় যারা পকেট মারা ও চুরির কাজ করত। এই অপরাধী দলটির নেতা ছিল ফাগিন। সে এসব বাচ্চাদের কিভাবে পকেট মারতে হয়, চুরি করতে হয় তা শেখাত। লন্ডনের বস্তির শিশু অপরাধীদের নিয়ে এরকম আরো অনেক কাহিনী আছে কিন্তু সেসব কাহিনীতে অনেক কিছুই অতিরঞ্জিত করে বিবৃত করা হয়েছে। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে এসব বস্তিতে বেড়ে ওঠা শিশুরা অল্প বয়সেই পেটের দায়ে এবং পরিবেশের প্রভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ত এবং এরকম অনেক অপরাধীদের সংঘবদ্ধ দলও ছিল। লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড (West End) এ অবস্থিত সেন্ট জাইলস (St Giles) বস্তিতে টমাস ডাগিন (Thomas Duggin) নামে এক লোক ছিল যে বাচ্চাদের পকেট মারা, চুরি করার প্রশিক্ষণ দিত।

উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝিতে এসব শিশু অপরাধী গ্যাং লন্ডন বাসীদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লন্ডনের বিচারকরা প্রতিদিন এরকম অনেক মামলার রায় দিতেন যেখানে শিশুরা পকেটমারা ও চুরির মতো অপরাধে জড়িত ছিল। লন্ডনের সেন্ট্রাল ক্রিমিনাল কোর্ট ওল্ড বেইলি (Old Bailey) নামে পরিচিত। ১৮৩০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে এই কোর্টে যত আসামী হাজির হয় তাদের অর্ধেকের বয়স ছিল ২০ বা তারও কম এবং এদের বেশিরভাগ বস্তির ছেলেমেয়ে। চুরির অপরাধে শাস্তি ছিল মৃত্যু। অনেককে জেলে পাঠানো হত বা অস্ট্রেলিয়াতে দ্বীপান্তরে পাঠানো হতো। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মাত্র দশ বছরের বাচ্চাকেও শাস্তি স্বরূপ এরকম দ্বীপান্তরে পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার ঘটনা:

ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের “Our Mutual Friend” নামের একটি উপন্যাসের চরিত্র ছিল গ্যাফার হেক্সহ্যাম (Gaffer Hexham)। গ্যাফারের পেশা ছিল টেমস নদী থেকে মানুষের মৃতদেহ উদ্ধার করা। এসব মানুষের মৃতদেহ উদ্ধার করে সে তাদের পকেটে যা কিছু থাকত এবং যেসব অলংকার থাকত সেগুলো সব খুলে নিত। এমন পেশার মানুষ ভিক্টোরীয় যুগের ইংল্যান্ডে ছিল। নদী থেকে যাদের দেহ তুলে নিয়ে আসা তাদের বড় অংশ বস্তিতে বসবাসকারী মানুষ। দারিদ্র্যে জ্বালা সইতে না পেরে নিজের জীবনের ইতি টানত।

এদের বড় অংশই ছিল নারী। আগেই উল্লেখ করেছি যে অনেক তরুণী দারিদ্র্যের কারণে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিত এবং এক পর্যায়ে মানসিক কষ্ট ও হতাশায় আত্মহত্যা করত। লন্ডনের টেমস নদীর সেতু, হাইড পার্ক, এগুলো ছিল আত্মহত্যার জন্যে জনপ্রিয়। এদের মৃতদেহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সনাক্ত করা যেত না। এসব মৃতদেহ লন্ডনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হাসপাতালে ছাত্রদের পড়াশুনার জন্যে দিয়ে দেয়া হতো।

অতি উচ্চ শিশু মৃত্যুহার:

উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে লন্ডনের বস্তিতে শিশু মৃত্যুর হার ছিল খুবই বেশি। এসব বস্তিতে জন্ম নেয়া প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একটি শিশু প্রথম বছরের মধ্যেই মারা যেত। তবে আস্তে আস্তে এই শিশু মৃত্যুর হার একটু একটু করে কমতে থাকে। ওল্ড নিকোল স্ট্রীট (Old Nichol Street) এ লন্ডনের সবচেয়ে কুখ্যাত বস্তিগুলোর একটা ছিল এবং এই বস্তিতে প্রতি চারজন শিশুর একজন এক বছরের মধ্যেই মারা যেত। এই সংখ্যাটা আরো বেশি হবে কারণ এরকম অনেক মৃত্যুই উল্লেখিত হতো না এবং এসব বাচ্চাদের ঠিকমতো দাফন করাও হোত না। আর যারা বেঁচে থাকত তারা যে চল্লিশ বছর পর্যন্ত বাঁচবে তারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। কারণ তারা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করত। উনবিংশ শতাব্দীতে লন্ডনে একজন অস্থায়ী শ্রমিকের জীবনকাল ছিল মাত্র ১৯। নারীদের ক্ষেত্রেও তাই। নারীরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করত না কিন্তু তারা কিশোরী বয়সে বাচ্চা নিত এবং প্রসবকালীন জটিলতায় মারা যেত।

শিশুদের নিশ্বাস-প্রশ্বাস জনিত জটিলতায় মৃত্যু:

শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের সাথে এক বিছানায় শুত এবং নিশ্বাস-প্রশ্বাস জনিত জটিলতায় অনেক শিশু মারা যেত।  বস্তির এসব ছোট ছোট ঘরগুলোতে একসাথে অনেক মানুষ গাদাগাদি করে থাকত। এক বিছানায় অনেক মানুষ শুলে যেটা হয় যে ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শুলে অন্যের গায়ের উপরে উঠে যায়। ইংরেজিতে একে বলা হয় “Overlaying”। এতে করে অনেক ক্ষেত্রে যেটা হত তা হচ্ছে ঘুমের মধ্যে দুর্ঘটনাবশত বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং তার মৃত্যু ঘটে। তৎকালীন একটি রিপোর্ট অনুসারে প্রতি ৬টি শিশুমৃত্যুর ৫ টি এরকম নিশ্বাস-প্রশ্বাস জনিত জটিলতার কারণে ঘটত।

কিন্তু এগুলোকে একেবারে দূর্ঘটনার মধ্যেও ফেলা যায় না। অনেক সমসাময়িক পর্যবেক্ষকের মতে এটা খুন। বাচ্চার বাবা-মা বিশেষ করে মা এই কাজটা করতেন। কারণ দারিদ্র্যে কারণে তিনি বাচ্চাদের খাওয়াতে পারতেন না। তখনকার ভদ্র সমাজের মতে, এটা হচ্ছে বস্তির মানুষের অনেক পাপ কাজ গুলোর একটি। তবে বর্তমান বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মতামত দিয়েছেন যে অনেক ক্ষেত্রে এটা দূর্ঘটনা জনিত মৃত্যু। সেই উনবিংশ শতাব্দীতে অনেক মা কেই এই দূর্ঘটনার জন্যে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয়েছিল।

যৌন নিগ্রহের শিকার হতো অবোধ শিশুরা:

এই প্রচণ্ড ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিতে শিশুদের যৌন নিগ্রহ ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। কতটা খারাপ অবস্থার মধ্যে ছোট শিশুরা এসব বস্তিতে বসবাস করত তা নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনা সম্পর্কে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা অন্যান্য সরকারি সংস্থাকে জানানো হত না। আর দুয়েকটা ঘটনা যেগুলো বের হয়ে আসত সেগুলো পত্র-পত্রিকায় এমন করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ছাপা হতো যে বাইরের কোন লোক সেটা পড়ে মনে করবে যে এই বস্তি হচ্ছে চরম পাপী লোকদের জায়গা। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদরা এ বিষয়ে একমত যে লন্ডনের বস্তিতে বসবাসরত শিশু ও অল্পবয়স্ক ছেলে এবং মেয়েরা প্রায়শই যৌন নিগ্রহের শিকার হতো।

এসব বস্তিতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস ছিল না। অন্ধকার সংকীর্ণ গলিপথে যৌন নিপীড়করা ঘাপটি মেরে বসে থাকত। তার উপরে এসব জায়গা গুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুলিশ থাকত না। খুব অল্প বয়স থেকে বস্তিতে বসবাসরত বাচ্চারা যৌন নিগ্রহের সাথে পরিচিত হয়ে উঠত। একটা ছোট ঘরে এত পরিমাণে লোক থাকত যে বাচ্চারা অনেক সময় তাদের অভিভাবকদের যৌনকর্মে লিপ্ত হতে দেখত। অল্পবয়সে এ ধরণের ব্যাপার তাদের উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলত।

ক্রমিক খুনির ছড়াছড়ি:

লন্ডনের বস্তি ক্রমিক খুনির জন্যে বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৮৮৮ সালের দিকে ক্রমিক খুনি জ্যাক দ্যা রিপার (Jack the Ripper) এর কাহিনী লন্ডনের মিডিয়া এবং পাঠকরা লুফে নেয়। লন্ডনের ইস্ট এন্ডের খুনের ঘটনায় তার নাম উঠে আসে। সে দরিদ্র অসহায় নারীদের হত্যা করত। তবে জ্যাক দা রিপার একা নন। এরকম অনেক খুনের ঘটনা ঘটেছিল সে সময়ে লন্ডনের বস্তিতে। অসহায় নারী, যারা পেটের দায়ে পতিতাবৃত্তি পেশাকে বেছে নিয়েছিল এমন সব নারীরা প্রচুর পরিমাণে খুন হতো। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা এসব খুনের ঘটনার কিনারা করতে পারছিলেন না এবং অনেক ক্ষেত্রে ঠিকমতো তদন্তও করা হোত না।

১৮৭২ সালে হ্যারিয়েট বাসঅয়েল (Hariet Buswell) নাম্নী এক অতিদরিদ্র অসহায় পতিতার খুনের ঘটনা নিয়ে পত্র-পত্রিকাতে লেখালেখি হয়। সন্দেহজনক এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাসওয়েল যেহেতু একজন অতিদরিদ্র নারী ছিলেন তাই তাকে নিয়ে অতটা মাথা ঘামানো হয় নি। লোকে বলে যে এখনো নাকি সেই জায়গাটি যেখানে এই নারী খুন হয়েছেন সেখানে তার আত্মা ঘুরে বেড়ায়।

বস্তির অপরাধ কাহিনী লন্ডনবাসীর কাছে ছিল দারুণ মুখরোচক বস্তু:

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শিক্ষিত লন্ডনবাসীর কাছে বস্তি এবং বস্তির মানুষ ছিল অবহেলার বস্তু। তারা এসব বিষয় নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাত না। তবে মজার ব্যাপার হলো এই বস্তিবাসীকে নিয়ে লিখিত গল্প তাদের কাছে খুবই মুখরোচক ছিল। একে বলা হচ্ছে “Slumland Storytelling”। ১৮৪০ এর থেকে এ ধরণের গল্প কাহিনীর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

উন্মত্ত হিংস্র মাতাল, পথভ্রষ্টা নারী, আর পথ শিশুদের নিয়ে লেখা হতো এসব গল্প। বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স (Charles Dickens) এর অলিভার টুইস্ট উপন্যাসটি এই সময়েই প্রকাশিত হয়। ১৮৩৭ থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যে এই উপন্যাসটি সিরিজ আকারে প্রকাশ করা হয়। ডিকেন্স ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, জ্যাক লন্ডন (Jack London), জর্জ সিমস (George Sims), আর্থার মরিসন (Arthur Morrison), জ্যাকব রিস (Jacob Riis) লন্ডনের বস্তি নিয়ে লিখেছেন। তারা লন্ডনের বস্তিতে ঘুরে ঘুরে এসব মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী প্রকাশ করত আর লন্ডনের মানুষজন সেগুলো গোগ্রাসে গিলত। তবে এসব কাহিনীতে অনেক কিছুই অতিরঞ্জিত করা হতো। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল অপরাধ কাহিনী (Crime Story)। লন্ডন, ম্যানচেষ্টার (Manchester) কার্ডিফ (Cardiff) লিভারপুল (Liverpool) সহ অন্যান্য বস্তি নিয়েও এই ধরণের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো।

বস্তিতে বসবাসকারীদের দুষ্কর্ম তাদের দূর্দশার জন্যে দায়ী: 

উনবিংশ শতাব্দীর বড় অংশ জুড়েই লন্ডনে বস্তির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু লন্ডনের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজের লোকেরা এটা নিয়ে মাথা ঘামাত না। কারণ এই দুই সমাজ তখনো মুখোমুখি হয় নি। তাদের মধ্যে ছিল বিরাজ করছিল বিশাল ব্যবধান। একজন শিক্ষিত, স্বচ্ছল লোকের এই বস্তিতে আসার কোন কারণ ছিল না। কাজের আশায় এসব বস্তির লোকের অন্য পাড়াতে যেত। এমনকি এই বস্তির বারবনিতারাও মূল শহরে আসত। দীর্ঘ সময় ধরে লন্ডনের ইস্ট এন্ড (East End) কে অন্ধকারময় লন্ডন বলে অভিহিত করা হতো। লন্ডনের শিক্ষিত সমাজের জন্যে এটা ছিল অজানা একটা পৃথিবী এবং এটা নিয়ে জানার বা বোঝার কোন চিন্তাও কারো মাথায় ছিল না।

এরপরে আস্তে আস্তে এমন একটা সময় এল যখন কারো পক্ষে এই বস্তি এবং বস্তিবাসীর অস্তিত্বকে আর অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু শিক্ষিত সমাজ কিভাবে এই বস্তি এল, এখানে যারা বাস করে তাদের কি সমস্যা? এসব বিষয় গুলো আলোচনা না করে বরং এসব বস্তিবাসীদেরকে তাদের সব দূর্ভোগের জন্যে দায়ী করতে লাগল। পত্র-পত্রিকা গুলো তাদের লেখায় গরীবদের অলস এবং অক্ষম হিসেবে তুলে ধরত। পরে ১৮৫০ সালের দিকে লোকজন বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হলো যে এসব মানুষের দুঃখ-দূর্দশার জন্যে দায়ী হচ্ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং আর্থ-সামাজিক মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্নতা।

রেললাইন নির্মাণের ফলে অনেক বস্তি ভেঙ্গে ফেলা হয় যার ফলে দরিদ্র মানুষ রাতারাতি সহায় সম্বলহীন হয়ে রাস্তায় নেমে আসে :

ব্রিটেনে ১৮২৫ সালে প্রথম রেলওয়ে চালু হয়। যুক্তরাজ্যের রেলনেটওয়ার্ক বিশ্বের ১৭ তম বৃহৎ রেল নেটওয়ার্ক।  ১৮৫০ এবং ১৮৬০ এর দশকে লন্ডনে বড় ধরণের পরিবর্তন নিয়ে আসে এই রেলওয়ে। রেলওয়ের মাধ্যমে ব্রিটেনের সব শহরগুলোকে যুক্ত করা হয়। এখন রেলওয়ে বানাতে জমি লাগবে এবং এসব বস্তি সরিয়ে রেললাইন তৈরি করা হয় এবং এর অবধারিত ফলাফল হচ্ছে অনেক দরিদ্র লোক সহায় সম্বলহীন হয়ে রাতারাতি রাস্তায় নেমে আসে। ঐ সব জমিতে যাদের বাড়িঘর ছিল তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় কিন্তু প্রচুর গরীব লোক এসব বাড়িতে ভাড়া থাকত। বাড়ি ভেঙ্গে ফেলার কারণে এরকম ৫৬,০০০ দরিদ্র লোকের মাথা গোজার ঠাইটাও হারিয়ে যায়।

কিছু কিছু বস্তি এলাকা একেবারেই ধ্বংস করে ফেলা হয়। এরকম একটি বস্তি এলাকা ছিল অ্যাগার টাউন (Agar Town) যেখানে হাজার হাজার আইরিশ অভিবাসীরা থাকত। মিডল্যান্ড রেলওয়ে তাদের গুদামঘর তৈরি করতে এই বস্তি পুরোটাই ভেঙ্গে ফেলে। শুধু রেললাইন নয়। ধনী ও অভিজাত শ্রেনীর ঘরবাড়ি তৈরি করার জন্যেও বস্তির জমি নিয়ে সেখানে তাদের থাকার জন্যে বড় বড় বাড়ি তৈরি করা হচ্ছিল। টমলিনস নিউ টাউন (Tomlin’s New Town) এরকমই একটি বস্তি এলাকা ছিল। এটির সাথে অনেক ইতিহাস যুক্ত ছিল। এই বস্তি ভেঙ্গে তার জায়গায় টাইবার্নিয়া (Tyburnia) স্টেট গড়ে তোলা হয়। এভাবে বস্তি ভেঙ্গে ফেলার কারণে কর্মজীবি মানুষদের অনেক সমস্যা হয়। এত দিন পর্যন্ত বস্তি ছিল শহরের ভেতরে এখন বস্তি গজিয়ে উঠল শহর থেকে একটু দূরে।

 আইন করেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয় নি:

১৮৭০ এর দশকে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এসব বস্তিগুলোর অবস্থা উন্নয়নের জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তারা দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক উন্নয়নের চিন্তা থেকে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। এসব বস্তির পরিবেশ ছিল খুবই নোংরা এবং যে পরিমাণে পরিবেশ দূষণ হচ্ছিল তা ব্রিটেনের মধ্যবিত্ত এমনকি অভিজাত পরিবারের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যেও মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এই ব্যাপারটাই বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন থেকে সরকারকে বলে আসছিলেন।

এর পাশাপাশি পুলিশ রিপোর্টও এসব বস্তিতে ক্রমবর্ধমান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড দেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে তাও উল্লেখ করা হয়েছিল।  ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন ডিজরেলি (Benjamin Disraeli) সাধারণ মানুষের অবস্থা উন্নয়নের আহবান জানান।

এরই ফলে ব্রিটিশ সরকারের তৎকালীন  হোম সেক্রেটারি রিচার্ড ক্রস (Richard Cross) ১৮৭৫ সালে   “The Artisans’ and Labourers’ Dwellings Improvement Act” প্রস্তুত করেন। এই আইনের আওতায় ব্রিটেনের স্থানীয় সরকার বস্তি এলাকাগুলোর জমি কিনে সেখান থেকে বসবাসকারীদের সরিয়ে সেই জমিতেই তাদের জন্যে বাড়ি করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে এমন নিয়ম করা হয়। এখন সমস্যা হচ্ছে, স্থানীয় কাউন্সিলের জন্যে এটা কোন বাধ্যতামূলক বিষয় ছিল না। যার ফলে অনেক কাউন্সিল এ ধরণের জমি কেনার পদক্ষেপ নেয় নি। এর পিছনে যে বিশাল খরচ সেটা মূল কারণ ছিল না। এর পিছনে আরো বড় কারণ ছিল যে অনেক ধনী লোক এই বস্তি এলাকায় বাড়ির মালিক ছিলেন। আইন চালু হবার পরে মাত্র ১০ টি কাউন্সিল এটি বাস্তবায়ন করে।

স্লামিং ব্যবসা :

আইন করেও ব্রিটিশ সরকার বস্তি সমস্যার সমাধান করতে পারে নি কিন্তু এতে করে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয় এবং সেটা হচ্ছে নতুন একটি ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়। স্বচ্ছল পরিবারের লোকেরা এসব বস্তি এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখত এবং ১৮৮০ এর দশকে এই স্লাম ট্যুরিজম লন্ডনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।  ধনী ও অবস্থাপন্ন লোকেরা নোংরা কাপড় পরে, মুখে গায়ে কালো রং ও ময়লা মেখে লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল (Whitechapel) এবং শোরডিচ (Shoreditch) এর বস্তি এলাকাগুলোতে ঘরে বেড়াত এবং দরিদ্র মানুষের কষ্ট চাক্ষুষ দেখত।

১৮৮০ এর দিকে লন্ডনে স্লামিং ব্যবসা বেশ জমে উঠল। “Slum” হচ্ছে ইংরেজি শব্দ যার মানে হলো বস্তি। এই শব্দটি থেকে “Slumming” শব্দটি এসেছে যার অর্থ হচ্ছে দরিদ্রদের জীবনাচরণ সম্পর্কে জানার কৌতুহল বা সাহায্যের উদ্দেশ্যে বস্তিতে সময় কাটানো।

নিঃসন্দেহে মানুষের কষ্ট ও যন্ত্রণা থেকে বিনোদন লাভ করা কোন সভ্য সমাজের জন্যে ভাল ব্যাপার নয়। তবে অনেকেই এটা করত কারণ তারা এর মধ্যে একটা থ্রিল খুঁজে পেত। ঐসব এলাকায় প্রায়শই খুন-খারাবি আর মারামারি হতো। এর মধ্যে একজন ঘুরে বেড়াচ্ছে এই বিপদকে মাথায় নিয়ে এর মধ্যে একটা সাহস আর উত্তেজনার ব্যাপার ছিল। তবে এই স্লামিংয়ের একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে এর আগে পর্যন্ত ব্রিটেনের স্বচ্ছল ও ধনী সমাজের লোকেরা মনে করত গরীব মানুষদের খারাপ স্বভাব তাদের দূর্দশার মূল কারণ। তারা সারাদিন মদ খায়, জুয়া খেলে, এবং নানারকম অপকর্মে লিপ্ত থাকে। এইজন্যেই তারা গরীব। কিন্তু স্লামিং এর ফলে তারা এসব মানুষদের জীবন কাছে থেকে দেখার এবং জানার সুযোগ পেল এবং তখন তারা বুঝতে পারল যে এদের মধ্যেও অনেক ভাল ও পরিশ্রমী লোক আছে যারা সম্মান পাবার যোগ্য। অনেকে দূর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে।

এই স্লামিং করার ফলে ব্রিটেনের বেশ কিছু ধনী পরিবারের লোকেরা কর্মজীবি মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় এবং তাদের উন্নত বাসস্থানের জন্যে ক্যাম্পেইন করা শুরু করে। উচ্চ সমাজের লোকের পাশাপাশি কর্মজীবি সমাজের নারীরাও সমসাময়িক সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে এবং নারী-পুরুষ সম্পর্কের চিন্তাধারাকে বদলে দিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

দারিদ্র্য ভ্রমণ খারাপ ব্যাপার হলেও গরীবদের অবস্থার উন্নয়নে এটি ভূমিকা রেখেছিল:

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বেশ কিছু ব্যক্তি এবং কয়েকটি সংগঠন ইংল্যান্ড জুড়ে দারিদ্র্য ও দরিদ্র মানুষদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। অনেক অবস্থাপন্ন এবং অভিজাত সমাজের নারীরা  লন্ডনের ইস্ট এন্ডে (East End) গরীবদের মতো ছেঁড়া এবং ময়লা পোশাক পরে ঘুরতে থাকে এবং দরিদ্র মানুষের জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। এসব অভিজাত মহিলাদের মধ্যে লেডি কন্সটেন্স ব্যাটারসি (Lady Constance Battersea) ও ছিলেন।  ব্যাটারসি ছিলেন বিখ্যাত ইহুদি ব্যাঙ্কার পরিবার রথসচাইল্ড বংশের সন্তান। তিনি এসব দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার যে বর্ণনা দেন তা ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আস্তে আস্তে বস্তি এবং বস্তিতে বসবাসকারী মানুষ সম্পর্কে আপামর জনসাধারণের ধারণা বদলাতে থাকে। এটাকে এখন লোকে সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে লাগল।

এসব ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি অনেক সংগঠন ইংল্যান্ডের বস্তিবাসীদের নিয়ে কাজ করতে লাগল। এদের মধ্যে ধর্মীয় সংগঠন এবং সামাজিক সংগঠনও ছিল। এসব সংগঠন দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্যে স্কুল ও লাইব্রেরি গড়ে তুলল যাতে করে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে পারে। একই সাথে সরকারের উপরেও চাপ দেয়া হলো যাতে এসব বস্তিগুলোর পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করা হয় এবং কুখ্যাত বস্তিগুলোর অপরাধী কর্মকাণ্ডের উপরে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। এর পর থেকে আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে তবে সবচেয়ে বড় কথা বস্তি এবং বস্তিবাসী মানুষ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন। সবাই বুঝতে পেরেছিল যে দারিদ্র্য একটি সামাজিক সমস্যা এবং দারিদ্র্য দূর করতে হলে সবাই মিলে একসাথে কাজ করতে হবে।

শেষকথা:

আজ আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বসবাস করছি। বর্তমানে আমাদের দেশের অর্থনীতী দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক সূচকেই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ আছে আমাদের সামনে। এর মধ্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঢাকা। বর্তমানে ১ কোটির বেশি লোক এই শহরে বসবাস করে। কিন্তু এই শহরে এত বিশাল পরিমাণ লোকের জন্যে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। অপরকল্পিত নগরায়নের ফলে প্রতিদিন ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ঢাকাবাসীদের। ঢাকাতেও প্রচুর বস্তি আছে এবং এসব বস্তিতে মানুষরা খুব কষ্টে দিন কাটায়। এই কিছুদিন আগেই মিরপুরের বস্তিতে আগুন লেগে এক নিমেষে কত মানুষ গৃহহারা হয়ে গেল।

কিন্তু ঢাকা হোক আর যুক্তরাজ্যই হোক প্রতিটি দেশকেই প্রতিমুহুর্তে এরকম নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আশা করি, বাংলাদেশও তার চ্যালেঞ্জ জয় করে সামনে এগিয়ে যাবে।

তথ্য সূত্র:

History Collection

বাংলাদেশ প্রতিদিন