আজ আমি এমন একজনের গল্প বলব যিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিখ্যাত । যিনি একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গনিতবিদ,জ্যোতিবিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ; তিনি আমদের এই সোনার বাংলার গর্ব, অহংকার। যার কল্যাণে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের নাম জজ্বোল্যমান। বিশ্বব্যাপী প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানীদের কাছে এই সোনার বাংলা তার নামেই সুপরিচিত। সেই বহুপ্রতিভাধারী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানব অন্য কেউ নন বরং আমাদের সুপরিচিত প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও গবেষক প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম ।
এই সুবিখ্যাত মানুষটি নিঃস্বার্থভাবে দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। এত বড়মাপের বিজ্ঞানী হয়েও শুধুমাত্র দেশের কথা ভেবে ১৯৮৪ সালে মস্ত সিদ্ধান্ত নেন এবং স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসেন। লক্ষ টাকার চাকরি , অফুরন্ত গবেষণার সুযোগ সকল কিছু ছেড়ে মাত্র তিন হাজার টাকার বেতনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। দেশকে তিনি বড্ড ভালবাসতেন। তাইতো এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিল না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এটার ভিন্নতা ঘটে নি কখনোই। আরেকটা দিক হল, বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থান সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব না।‘ তার দেশপ্রেমের নিদর্শন ১৯৭১ সালেও তিনি দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নির্বিচারে হত্যা খুন ধর্ষণে মত্ত হয়েছিল, তখন পাক-বাহিনীর এই আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠিও লিখেছিলেন।
দেশে ফিরে বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য তিনি কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। শুধু বিজ্ঞানেই তার অবদান ছিল না, তিনি আরো কাজ করেছেন দারিদ্র দূরীকরণে, শিল্প ব্যবস্থার উন্নয়নে । তার মতে, আমাদের দেশটা যেহেতু কৃষিনির্ভর, তাই, আমাদের শিল্পনীতি হওয়া চাই ‘কৃষিভিত্তিক, শ্রমঘন, কুটিরশিল্প-প্রধান’ এবং ‘প্রধানত দেশজ কাঁচামাল-নির্ভর’। তাই বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ-এর ক্ষতিকারক প্রেসক্রিপশন বাদ দিয়ে নিজেদের প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটা সুষ্ঠু শিল্পনীতির প্রতি সবসময় গুরুত্ব দিতেন।
বই পড়তে তিনি খুব ভালোবাসতেন সাথে বই পড়ুয়াদেরকেও। বিভিন্ন শখের মধ্যে গান শোনা য়ার ছবি আঁকা তার ছিল খুবই প্রিয়। ছাত্রদের বই উপহার দেওয়াও তার দারুন পছন্দের কাজ ছিল। নিজের খরচের অর্থ জমিয়ে তিনি দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যাবস্থা করে দিতেন। এদেশ থেকে যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে যেত তাদের সকলকে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহ দিতেন এবং দেশের জন্য কাজ করতে বলতেন। তার মত মহান নিভৃতচারী মানুষ খুব কমই আছে। তাইতো তার জীবদ্দশায় খুব কম লোকেই তাকে চিনত।
তিনি বিজ্ঞানের উপর বিভিন্ন বই লিখেছেন । তার মধ্যে The Ultimate Fate of The Universe কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ সাড়া ফেলতেও সক্ষম হয়। জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ ও যুগোশ্লাভিয়া ভাষায় অনূদিত হয় এই বইটি। এছাড়াও তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- Classical General Relativity, Rotating Fields in General Relativity, An Introduction to Mathematical Cosmology ।ইংরেজি ভাষায় লেখা জটিল ও দূর্বোধ্য বিজ্ঞান বিষয়কে বাংলা ভাষায় লিখে এদেশের মানুষের মাঝে তা জনপ্রিয় করে তুলেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত “কৃষ্ণ বিবর” “মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ” শিল্প সাহিত্য ও সমাজ” বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অনবদ্য গ্রন্থ যা বাংলার অমূল্য সম্পদ।
তিনি আমাদের পথ প্রদর্শক, আমদের সপ্নদ্রষ্টা। তিনি আমাদের উৎসাহ , উদ্দীপনা যুগিয়েছেন দেশের জন্য, দশের জন্য কাজ করতে । দেশের আপামর ছাত্রসমাজের অনুপ্রেরণার চাবিকাঠি এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী্র জন্ম ঝিনাইদহ শহরে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে। আর তিনি পরলোকগত হন ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ। বিশ্ব, বাংলা ও বাংলার মানুষ কোনদিন তার অবদানকে ভুলতে পারবে না। তাই তিনি যেখানেই থাকেন আশা করি ভালো থাকবেন।