অন্ধকে যিনি দিয়েছেন জ্ঞানের আলো
ফরাসী একজন শিক্ষক- যিনি এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, যা লেখা ও ছাপার কাজে ব্যবহৃত হত। কিন্তু এই লেখা পড়তে হলে আপনাকে চোখ ব্যবহার করতে হবে না, ব্যবহার করতে হবে, হাতের স্পর্শ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। হাতের আঙুল এর স্পর্শ এর সাহায্যে পড়তে হয় এই লেখা৷ এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন কাকে নিয়ে কথা বলছি?
হ্যাঁ, লুইস ব্রেইল।
১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারী, প্যারীস শহর থেকে ২৫ মেইল পুর্ব দিকে অবস্থিত কাউপভ্রে গ্রামে তার জন্ম। মাত্র তিন বছর বয়সে, বাবার কারখানায় খেলাধুলার সময়, সুচালো যন্ত্রের আঘাতে তিনি তার দৃস্টি শক্তি হারান। মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই অন্ধকার তার সংগী।
কিন্তু সেই অন্ধকারে তিনি হারিয়ে যাননি৷ পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ আগ্রহী। সেই সময়ে অন্ধদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা তেমন একটা ভালো ছিলো না। কিন্তু তিনি নিজে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। তাই তার বাবা অনেকটা জোর করেই তাকে সাধারণ স্কুলে স্বাভাবিক ছাত্রদের সাথেই তাকে পড়াশোনার জন্য ভর্তি করিয়ে দেন৷ তার তুখোড় মেধার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ও না করতে পারেননি৷
১৮১৯ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তিনি প্যারীস শহরের National Institute for Blind Children এ ভর্তি হন। ১৮২৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই শিক্ষা লাভ করেন৷ এই সময় তিনি সহজ পদ্ধতিতে লেখার পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করেন, যা ব্রেইল পদ্ধতি মুলত অন্ধরাই ব্যবহার করতো লেখার কাজে।
চার্লস বার্বিয়ার এর মিলিটারী ক্রিপ্টোগ্রাফি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজে নিজেই একটা পদ্ধতি (কাগজের উপর ডট তৈরী) আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে অন্ধমানুষেরা অনেক দ্রুত এবং সহজ ভাবে লিখতে সক্ষম হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। । ১৮২৪ সালে তিনি তার এই আবিষ্কার সকলের সামনে তুলে ধরেন৷ যুগান্তকারী এক আবিষ্কার। সকলেরই মন কাড়লো। বিশেষ করে অন্ধদের৷ ভীষণ ভাবে তারা পছন্দ করে ফেললো এই পদ্ধতি৷ খুব সহজেই তারা লিখতে ও পড়তে পারছিলো৷
কিন্তু, হঠাৎ করেই ঘটে একটা দুর্ঘটনা। ব্রেইল তার ৪৩ তম জন্মদিনের দুই দিন পরই অর্থাৎ ১৮৫২ সালের ৬ জানুয়ারী, তার প্যারীসের সেই স্কুলে মারা যান। প্রায় এক বছর ধরে তিনি যক্ষায় ভুগছিলেন।
ব্রেইল এর লেখার সেই পদ্ধতি অনেক অন্ধ মানুষের পড়ালেখার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিলো । কিন্তু তার জীবদ্দশায় তিনি তার এই কাজের স্বীকৃতি পান নি।
তার মৃত্যুর দুই বছর পর ফ্রেঞ্চ সরকার, ব্রেইল এর আবিষ্কৃত ডট সিস্টেম কে জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। জাতীয় ভাবে সবাই অন্ধদের লেখাপড়ার জন্য এই ডট ব্যবহার করতে পারবেন৷
১৮৭৮ সালে এই পদ্ধতি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে পৃথিবীর মোটামুটি প্রায় সব অফিসিয়াল ভাষাতেই এই ব্রেইল এর ডট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷
ও হ্যা বলাই তো হয়নি৷ তার সম্মানার্থে তার আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি কে ব্রেইল পদ্ধতি বলা হয়৷
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ব্রেইল এর জন্ম ও মৃত্যু দিবসকে স্মরণ করে নানান ধরণের ডাকটিকিট প্রকাশ করে আসছে।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোন ডাকটিকিট প্রকাশ করে নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক৷
গতকাল ছিলো তার মৃত্যু দিবস৷ সারা পৃথিবীর সকল ফিলাটেলিস্ট রা গভীর শ্রদ্ধার সাথে তার এই অবদান কে স্মরণ করেছে, তাদের ভালোবাসার ডাকটিকিট প্রদর্শনীর মাধ্যমে৷
তিনি এই ‘ব্রেইল পদ্ধতি’ আবিস্কার করেছেন বলেই হয়তো চোখের আলো হারানো মানুষগুলো মনের আলোয়, শিক্ষার আলোয় নিজেকে, সমাজকে, এই পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারছে৷
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত কিছু ডাকটিকিট এর ছবি আমি শেয়ার করছি৷
আশা করি, আপনাদের ভালো লাগবে৷
★সবশেষে অনুরোধ করবো, ডাকটিকিট সংগ্রহ করুন৷ একটা ডাকটিকিট আপনাকে ১০ টা বই পড়ার অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে। একটা ডাকটিকিট আপনাকে জোগান দিতে পারে অন্তত ১০ টা অজানা তথ্য।