১৬ অক্টোবর লন্ডনের গিল্ড হলে দেওয়া হলো এই পুরস্কার। বহু বছর ধরে এ পুরস্কারের ধারাটাই হয়ে উঠেছে এমন: পুরস্কার দেওয়ার পর থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত বইটি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রশংসা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দুই-ই আছে অ্যানা বার্নসের এযাবৎ রচিত তিনটির মধ্যে সর্বশেষ এই উপন্যাসকে ঘিরে।

 

বছর কয়েক আগেও বেশ কয়েকজন প্রকাশক ফেরত পাঠিয়েছিলেন এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি। অ্যানা যখন লিখছিলেন, ঠিকমতো খাবার জোটেনি—বদান্য তহবিলের ফুড ব্যাংক জীবন বাঁচিয়েছে। বিচিত্র কাজ তাঁকে করতে হয়েছে জীবিকার সন্ধানে, পরিচিতজনের বাড়িরও দেখভাল করেছেন অর্থের প্রয়োজনে। অ্যানার এই বই তাই ভেতরের সারবস্তুতেই শুধু নয়, নেপথ্যের আখ্যানেও বিশেষ।

বুকার জয়ের ৫০ হাজার পাউন্ড পুরস্কার অ্যানা বার্নসের কাছে স্বস্তির, তিনি এই অর্থ দিয়ে ‘ঋণ শোধ করবেন প্রথমত’ এবং তারপর বাকিটুকু জীবন ধারণের জন্য ব্যয় করবেন, জানিয়েছেন বুকার জয়ের প্রতিক্রিয়ায়।

মিল্কম্যান

মিল্কম্যান গ্রন্থে এ কৃতজ্ঞতা অ্যানা স্বীকার করেছেন খাবারের জোগানদার সেই ফুড ব্যাংকের প্রতি। বুকার জয়ের পর তারাও লেখককে অভিনন্দিত করেছে।

ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অ্যানা বলেন, কিছুদিন আগেও তিনি জানতেন না, আদৌ লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারবেন কি না। উত্তর আয়ারল্যান্ডে নিম্নবিত্ত ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম নেওয়া সাত ভাইবোনের একজন অ্যানা। ১৯৮৭ সালে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। বলা যেতে পারে, নিয়তিই টেনে নিয়ে গেছে তাঁকে লেখার দিকে।

অতীত মুছে ফেলা যায় না। যুদ্ধ চলে গেলেও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম সেই স্মৃতিকে কখনোই পেছনে ফেলে আসতে পারে না। তাই অনেকেই যখন অ্যানাকে বলেছেন, বিক্ষুব্ধ সেই সময়ের মাতৃভূমিকে ভুলে যেতে; তিনি তা পারেননি। মিল্কম্যান-এর মূল চরিত্র বা মূল কথক তাঁর নিজেরই ছায়া।

তাঁর প্রথম উপন্যাস নো বোনস সম্মানসূচক অরেঞ্জ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় ২০০২ সালে, এরপর লেখেন লিটল কনস্ট্রাকশনস।

তৃতীয় এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে অ্যানা আশা করেননি বইটি বিক্রেতাদের মুখে খুব একটা হাসি ফোটাবে। কারণ, কোনো কোনো বই নিজেই আমাদের টেনে নিয়ে যায়, কোনো কোনোটিকে আমাদের টেনে নিয়ে যেতে হয়। মিল্কম্যান দ্বিতীয় পদের। কেউ কেউ রাজনীতিবিদদের জন্য এই উপন্যাসকে অবশ্যপাঠ্য বলছেন। বলা ভালো, মিল্কম্যান-এর মধ্য দিয়ে উত্তর আয়ারল্যান্ডের কোনো লেখক এই প্রথম বুকার পেলেন।

উপন্যাসেটির ঘটনা তেমন ঘনঘটাপূর্ণ নয়। এর স্থান ও সময়ের ক্ষেত্রে ছাপ পাওয়া যায় সত্তরের দশকের উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টের (বেলফাস্ট লেখকের জন্মভূমিও)। ১৯২১ সালে উত্তর ও দক্ষিণ—এই দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার পর দক্ষিণাংশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও উত্তরাংশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রয়ে যায়। কিন্তু ব্রিটিশ, আইরিশ জাতীয়তাবাদ বিভক্তি ষাটের দশক থেকে প্রায় তিন দশকব্যাপী দেশটিকে গৃহযুদ্ধে সব সময় সহিংস, সাংঘর্ষিক রেখেছে। প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। এই সময়টি ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে ‘দ্য ট্রাবলস’ হিসেবে।

একদিকে রাষ্ট্র, অন্যদিকে জনগোষ্ঠী। সবটাজুড়ে কেবল অবিশ্বাস। কেবল ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’—এই বিভক্তি। মিল্কম্যান-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র এই অবিশ্বাসী সময়ে বেড়ে ওঠা ১৮ বছরের কিশোরী ‘মিডল সিস্টার’।

বইটি ব্রেক্সিট আর ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনের আগে লেখা হলেও এর মধ্যে দুটিরই প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।

এটা কি হুবহু ইতিহাসের সেই ‘ট্রাবলস’-এর সময়টার কথাই বলে? ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানকে অ্যানা বার্নস বলেছেন, তিনি বরং এমন এক সমাজের কথা বলেন, যেটি দীর্ঘকাল ধরে চলা সহিংসতাকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েছে—‘টোটালিটেরিয়ান’ এবং বদ্ধ সমাজ। সেটা যেকোনো জায়গায় হতে পারে।

এ উপন্যাসের ‘মিডল সিস্টার’ চরিত্রের আখ্যানও আমাদের সে কথাই বলে। রাষ্ট্র ও তার সংগঠনগুলো পরস্পরের মুখোমুখি এমন অবস্থানে চলে গেছে যে সেই ব্যবস্থার মধ্যে থাকা মানুষগুলো সহিংসতা ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতিতে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, তারা যে একসময় নিজেদেরই বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ছে, তা-ও যেন বুঝতে পারছে না। এই সহিংস মানসে বই ধরা হাতের চেয়ে বোমা হাতে ধরা হাত তার কাছে বেশি পরিচিত। ‘হাঁটতে হাঁটতে বই পড়ে’ এমন কেউই ‘সন্দেহজনক’। ‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ সেমটেক্স (বিস্ফোরক) সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা একদম ঠিক আছে, আর আমি দিনদুপুরে জেন আয়ার পড়লে সমস্যা?’—মিডল সিস্টার চরিত্রটি জানতে চায়।

একদিন পড়তে পড়তেই ৪১ বছর বয়সী, বিবাহিত, আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ‘মিল্কম্যান’-এর চোখে পড়ে যায় সে। লোকটির প্রেমে পড়েনি সে মোটেই, বরং মোটর মেকানিক ‘মে বি বয়ফ্রেন্ড’ অথবা ‘নেয়ারলি বয়ফ্রেন্ড’—এমন নামহীন চরিত্রের সঙ্গে মিডল সিস্টারের সত্যিকার একটা সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তার চারপাশে তাকে এবং মিল্কম্যানকে ঘিরে গুজব ছড়াতেই থাকে। ভয় পেলেও কাউকে সে কিছু বলতে পারে না। কারণ, লোকটি তাকে শারীরিকভাবে আক্রান্ত করেনি। অথচ সর্বত্র তার উপস্থিতির চিহ্ন তার কাছে স্পষ্ট। সে হুমকি দিচ্ছে মিডল সিস্টারের বন্ধুর গাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে। মা-বোনেরা তাকে তিরস্কার করছে। এই ব্যাপক দূরত্ব, অন্যদিকে কোথাও কিছু বলতে না পারার অসহায়তা কোথায় নিয়ে যাবে তাকে?

এই সার্বক্ষণিক যন্ত্রণার মধ্যেও অটুট মিডল সিস্টারের রসবোধ। হয়তো বেঁচে থাকার এ-ও এক কৌশল।

কতটা সন্ত্রস্ত আর অস্বাভাবিক সময়ে তার বাস, বোঝা যায় একটি ঘটনায়—উপন্যাসে দেখা যায়, তাদের ফরাসি ক্লাসের শিক্ষক, আকাশের রং একাধিক—এটি তাদের বিশ্বাস করাতে পারছেন না। ‘বাপ-দাদা, মা-নানিরা, যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে’ দেখে আসছেন আকাশের রং নীল। হঠাৎ কেন তাতে চারটি রং থাকবে? শিক্ষক তাদের জানালা দিয়ে তাকাতে বললে যেন জীবনের প্রথম তারা দেখতে পায়, হঠাৎ বিকেলের আকাশটা বেগুনি, গোলাপি, হলদেটে—অর্থাৎ আকাশে তখন অনেক রং। ঘটনার আকস্মিকতায় এরপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা, ইতিহাসের ক্রূর সময়ে যুদ্ধবাজ, বিভক্ত এক সমাজের থামিয়ে রাখা সত্যগুলোকে একটা আতশ কাচ দিয়ে দেখার মুহূর্ত। যুদ্ধ আর সহিংসতা স্বাভাবিকতাকে এখানে হত্যা করে।

সুতরাং আবার যখন উপন্যাসের কথক ফিরে আসে তার বদ্ধ সমাজে, ওর কথনের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে ওঠার চরম মূল্য দেখতে পাওয়া যায়। কী করে একজন আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য শুধু ক্ষমতার জোরে সবাইকে বিশ্বাস করাতে পারছে একটি অস্তিত্বহীন সম্পর্কের বিষয়ে এবং একই সঙ্গে প্রভাব বিস্তার করছে সমাজ ও একান্ত ব্যক্তিগত চৌহদ্দিতে। অ্যানা বার্নস ক্ষমতার বিন্যাস আর তার চর্চার মধ্যে এভাবেই রাজনীতিকে দেখতে পান। ফলে তাঁর এ উপন্যাস প্রত্যক্ষ তত্ত্ব দেয় না, তবে দেখায় জীবনকে।

আগেই বলা হয়েছে, মিল্কম্যান-এর চরিত্রদের কোনো নাম নেই। চরিত্রদের নাম কেন দিলেন না? সাংবাদিকেরাও প্রশ্নটি করেছেন লেখককে। উত্তরে অ্যানার জবাবও স্পষ্ট: ‘এই চেষ্টা (নাম দেওয়ার) আমি করেছিলাম, কিন্তু তাতে চরিত্রগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল, গল্পটা হারিয়ে যাচ্ছিল, সেটাকে আর কোনোভাবেই টেনে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছিল না।’

গোটা আখ্যানে নাম ও সময়হীনতার এই প্রতীক হয়তো এই জন্যও যে যুদ্ধ আজও চলছে; অগুনতি শিশু, নারী, পুরুষ অবিরত বলি হয়ে চলেছে ‘অস্বাভাবিক’-এর চরম ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠার দিনলিপিতে। বই হাতে নেওয়া ব্যতিক্রমী বালকটির চেয়ে বিস্ফোরক অথবা মাদক হাতে নেওয়া ‘স্বাভাবিক’ বালক, যে পৃথিবীতে ক্রমেই স্বস্তিদায়ক ও পরিচিত!

সুত্র প্রথম আলো