হামহাম জলপ্রপাত – মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার কলাবন পাড়া গ্রাম। যেখানে পৌঁছায়নি বিদ্যুতের আলো, শিক্ষার আলো যেখানকার মানুষদের আত্মা ছোঁয়নি এখনো। কূয়ার পানি আর চা পাতা তুলে, পাহাড়ী শাকসব্জি খেয়ে যেখানে জীবন ধারণ চলে। সেই কলাবন পাড়া গ্রামের কিনারে চম্পারায় চা বাগান। সেখান থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঝরে পড়ছে হাম হাম জলপ্রপাত। সমতল থেকে প্রায় ৮০০ ফুট উচ্চতা পেরিয়ে পৌঁছতে হয় সেখানে। পথে পাড়ি দিতে হয় ১৪ টি মোকাম টিলা, ঝিরিপথ আর অনেক গুলো ছোট বড় ছড়া। ঝিরিপথ আর ছড়ার মাঝে কাদামাটির মাঝে লুকিয়ে আছে চোরাবালি, পোকামাকড়, জোঁক আরো নাম না জানা কীট পতঙ্গ। সাপ, বানর, ব্যাঙ সহ আরো অজানা প্রাণীর দেখাও মেলে মাঝে মাঝে। পথের সঠিক কোন দিক নির্দেশনা নেই, নেই কোন ম্যাপ কিংবা গাইডদের যথার্থ জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ।
এতো প্রতিকূলতার মাঝেও হঠাৎ করেই আমাদের ইচ্ছে হলো হামহাম জলপ্রপাত দেখতে যাবো। ট্রেকিং করিনি কখনো, ভাল কোন ধারণাও নেই। ছিলোনা কোন প্রস্তুতি। হাই গ্রীপের জুতা, ফার্স্ট এইড কিট, কাঁধে ঝুলানো ওয়াটার ব্যাগ, কম্পাস কিছুই ছিলোনা সাথে। ছিলো কেবল ইচ্ছাশক্তি, মনোবল আর আড়াই বছরের অর্জিত নিজের ফিটনেসের প্রতি আস্থা। এএসপি সাহেবের পুলিশি ট্রেনিং আছে তাই তার নিজের জন্য চিন্তা ছিলোনা। চিন্তা ছিলো আমাকে নিয়ে, যে আমি তিন ঘন্টা বন্ধুর পথ হেঁটে ঝরণা দেখে আবার তিন ঘন্টা হেঁটে ফিরতে পারবো কিনা। সাঁতার না জানা, হাইট ফোবিয়ার এই আমার কেবল মাত্র আড়াই বছরের ফিটনেস জার্নিকে সংগত কারনে খুব বেশি ভরসা সে করতে পারছিলো না।
কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। ট্রেকিং এ যাবোই। অগত্যা ২৯/৯/১৮ এ আমরা হাম হাম ঝরনা দেখতে যাবার পরিকল্পনা করলাম। সকাল আটটাই নাস্তা করে মৌলভীবাজার থেকে সারাদিনের জন্য সি এন জি রিজার্ভ করে রওনা দিলাম কমলগঞ্জের কলাবন পাড়া গ্রামে। সেখানে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে, কিছু শুকনা খাবার আর পানি নিয়ে একজন গাইডের সাথে চম্পারায় থেকে পদব্রজে রওনা দিলাম। রাজকান্দি বনাঞ্চলের ধারে বনবিভাগের অন্তর্ভুক্ত কুরমা বিটের অফিসে নাম এট্রি করে বাঁশের লাঠি নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
আমরা দুইজন যাচ্ছি দেখে অনেকেই অবাক হচ্ছিলো। বনের গভীরে যখন ঢুকি, নিঃশব্দতা ঘিরে ধরে আমাদের। মাঝে মাঝে গাইডের কথা, আমাদের পা ও নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিলো না। কিছুদূর যাওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের একদল ছেলে মেয়েদের সাথে যুক্ত হলাম আমরা। আমাদের একাকিত্ব ঘুচলো। ক্যাজুয়াল স্যান্ডেল পরে অনেক রাস্তা হাঁটা যাচ্ছিলো না বলে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে খালি পায়েই রওনা দিলাম। হাইট ফোবিয়ার কারনে খাদে তাকাইনি আমি। একটা নির্দিষ্ট স্পীডে হেঁটেছি। মাঝে মাঝে একটু থামা, একটু পানি পান করা আর ছবি তোলা ছিলো আমাদের দীর্ঘ ক্লান্তিকর জার্নির প্রাণোদ্দীপনা। হৈচৈ করে বেশ এগোচ্ছিলাম আমরা। বিপত্তি ঘটলো যখন আমাদের টিমের কয়েকজন কে জোঁকে ধরলো। কোন রকমে লবন দিয়ে জোঁক থেকে মুক্তি পাওয়া গেলেও, বাঁশের চটায় পা কাটা থেকে মুক্তি মিলেনি। জোঁকের ভয়ে আমি এক জায়গাও স্থির থাকিনি, তবুও পায়ে উঠেছিলো জোঁক ব্যাটা। শুধু কি তাই, সামনে দিয়ে সাপ হেঁটে যাওয়া, প্যাঁক কাদায় পা ডুবিয়ে হাঁটা আর বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো পার হবার সময় ট্র্যাকিং এর অর্থ খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পারছিলাম।
এই সব মোকাবিলা করে রোদ গরম, খানা খন্দ রাস্তা পেরিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা পর পৌঁছালাম আমাদের কাঙ্খিত স্থানে। ঝরণার ঝরোঝরো শব্দ, প্রায় ১৪৮ ফুট উঁচু থেকে আছড়ে পড়া প্রবাহ, অপরূপ নৈসর্গিক প্রকৃতি আর হিম শীতল পানিতে মুহূর্তেই দূর হয়ে গেলো সকল ক্লান্তি। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। কোন এক মোহের টানে ঝরণা সবাইকে নিজের দিকে টেনে রাখে কে জানে। হাল্কা কিছু নাস্তা আর পানি খেয়ে ঝরণার পানিতে জলকেলি করে আবেশিত হলাম আমরা। ইতোমধ্যে আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। বৃষ্টি হয় হয়। গাইড আমাদের ওঠার জন্য বার বার তাড়া দিতে থাকে। বৃষ্টি হলে ফেরা খুব কঠিন হয়ে যাবে। পথ হয়ে যাবে পিচ্ছিল। সামান্য অসতর্কতায় পড়ে যেতে হবে প্রায় ৮০০ ফুট নিচের খাদে। হারিয়ে যেতে হবে চিরতরে। কিন্তু আমাদের তো আর ফিরতেই ইচ্ছে করেনা। মনে হয় সেখানে থেকে যাই অনন্তকাল।
বেলা দুইটাই কালো মেঘে আঁধার করে আসে। আমরা ফেরার পথ ধরি। ঘন জঙ্গলে নেমে আসে নিশুত রাত। মোবাইলের আলোয় আমাদের পথ চলতে হয়। নেটওয়ার্কের বাইরে থাকায় জগতের সাথে যোগাযোগ হয়না। ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে আমাদের। ক্লান্তিও জেঁকে বসে শরীরে। ফেরার পথকে বড়ই দীর্ঘ মনে হয়। কাপড় থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে পথ হয়ে যায় পিচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ পাহাড়ের ঢালে পা পিছলে যাই আমার। এএসপি সাহেব হাতটা না ধরলে হয়ত পড়ে যেতাম গহীণ খাদে। ভাগ্যের জোরে আর প্রিয় মানুষগুলোর প্রার্থনায় বেঁচে গেলাম সে যাত্রা।
এরপর আর কি, সমস্ত ক্লান্তিকে একপাশে সরিয়ে সকল মনের জোরকে একত্র করে সন্তর্পণে এগিয়ে যাই আমরা। প্রার্থনা করতে থাকি বৃষ্টি যেন না হয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রার্থনা শোনেন। মেঘ কেটে যায়, রোদ ওঠে। আর আমাদেরও মনের জোর বাড়তে থাকে আর বাড়তে থাকে পায়ের গতি। প্রিয়জনদের কাছে ফেরার তাগিদে আমরা আড়াই ঘন্টায় পৌঁছে যাই আমাদের চেনা গন্তব্য।
ছয় ঘন্টা পর কলাবন পাড়া গ্রামে ফিরে কূয়োর পানিতে ফ্রেশ হই। যেহেতু কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছিলোনা, তাই ভেজা কাপড় বদলানোর কোন উপায় ছিলোনা। সেই অবস্থায় আগে থেকে অর্ডার করা গ্রাম্য এক ছাপড়া হোটেলে মোটা চালের ভাত, দেশি মুরগীর ঝাল ঝাল ঝোল, মুগ ডাল, আলু ভর্তা, পাহাড়ি শাক ভাজি আর চা পাতা ভর্তা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করলাম। ক্ষুদা পেটে সেই খাবারই অমৃতের মতো লাগলো আমাদের। ওদিকে সূর্য তখন ডুবে গেছে পাহাড়ের আড়ালে। এবার আমাদের ফেরার পালা। গাইড, হোটেলের লোকজন আর সাথের রাবির ছাত্র ছাত্রীদের বিদায় জানিয়ে সি এন জি চেপে ফিরে এলাম মৌলভীবাজার সার্কিট হাউজে। আর পিছনে রাজকান্দি বন, হাম হাম ঝরনায় রেখে এলাম আমাদের ক্ষণিক অনুভূতির মিশ্র স্মৃতি।
পাদটীকাঃ প্রস্তুতি ছাড়া ট্রেকিং এ যেয়ে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। পরবর্তীতে কেউ গেলে যেন আমাদের মতো সমস্যায় না পড়ে তাই অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু টিপস দিলাম।
১. হাই গ্রীপের বেল্ট ওয়ালা কম্ফোর্টেবল রাবারের ফ্ল্যাট স্যান্ডেল সু পরবেন। কাদামাটি ও পাহাড়ে ওঠার জন্য ভাল।
২. ডার্ক কালারের কম্ফোর্টেবল প্যান্ট আর টিশার্ট বা ফতুয়া পরতে পারেন।
৩. রোদ থেকে আরাম পেরে ক্যাপ আর সানগ্লাস ইউজ করতে পারেন। আমি চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পাইনা। আর ঘামে চশমা ঘোলা হয়ে যায়, তাই কোনটাই পরতে পারিনি।
৪. পানি, খাবার স্যালাইন, গ্লুকোজ নিবেন। ডাব পেলে ডাব খাবেন।
৫. অনেকক্ষণ পেটে থাকে, এনার্জি দেয় সহজে বহন যোগ্য খাবার যেমন কাঠ বাদাম, আপেল, খেজুর, সিদ্দ ডিম নিবেন।
৬. কাটা ছেঁড়া আর জোঁকের হাত থেকে বাঁচতে ব্যান্ডেজ, স্যাভলন, লবন নিবেন।
৭. ব্যাক প্যাক যতো কম ওজনের হয়, ততোই ভাল। ওয়াটার প্রুফ ব্যাগ নিবেন।
৮. মোবাইল কাভার ইউজ করবেন।
৯. গামছা বা তোয়ালে নিবেন।
১০. আলাদা শুকনা কাপড় নিয়ে গ্রামের কিনারের হোটেলে রেখে যাবেন।
এডভেঞ্চারপ্রেমী সকলের জন্য শুভকামনা।
—-অপরাজিতা অর্পিতা
You must be logged in to post a comment.