আজ আমায় ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেক গুলো বাজার নিয়ে এসেছে। মা পুরো ঘর দোর ঝার মোছ করছেন। এ দৃশ্য আমার কাছে নতুন নয়। প্রায়ই এরকম হচ্ছে আমাদের ঘরে। প্রতিবারই ছেলে পক্ষ এসে আমাকে এসে দেখে খেয়ে দেয়ে চলে যায়। বলে পরে জানাবে আমাকে পছন্দ হয়েছে কিনা। কিন্তু সেই পর আর হয়না। অবশ্য যাবার আগে আমার হাতে ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে যায়। আমি টাকাটা বাবাকে দিয়ে দেই।তাতে অন্তত বাজার খরচটা কিছুটা হলেও পোশায় বাবার।
মা আমার কাছে এক বাটি কাঁচা হলুদ বাটা নিয়ে আসলেন। বললেন বস এসে আমার কাছে একটু গায়ে মুখে লাগিয়ে দেই। এ দৃশ্য টিও আমার কাছে পুরোনো। প্রতিবারি ছেলে পক্ষ আসার আগে মা এই কাজ করেন। যেন তার কালো মেয়েটির গায়ের রং কিছুটা হলেও ফর্সা দেখায়।
মা যেভাবে বলেন আমি ঠিক সেভাবেই সবকিছু করি। কিন্তু আমি কি করবো বলেন ছেলেরা আমাকে পছন্দ না করলে? আমার বিয়ে হচ্ছে না এ ব্যাপারে আমার খুব বেশি মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু কস্ট হয় ছেলে পক্ষ চলে যাবার পর বাবার চেহারাটা দেখলে। মনটা খারাপ করে বসে থাকেন অনেকক্ষণ। ছোট একটি মুদি দোকানদার এর কালো মেয়েটিকে কে বিয়ে করবে এ চিন্তায় কপালে ভাঁজ পরে। আর মা মেহমানদের এঁটো থালা বাটি ধুতে ধুতে চোখ মোছেন।
আমি সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করি। কিইবা করার আছে আমার।
দুপুরে ছেলেপক্ষ চলে আসে আমাদের বাসায়। আমি হালকা হলুদ রংয়ের একটা শাড়ি পড়েছি। কপালে মেচিং টিপ আর কানে ছোট দুল। মা তড়িঘড়ি করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বললেন তুই রেডি তো? আমি রেডি মা। মা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, মাশাআল্লাহ আমার মেয়েটাকে কত সুন্দর লাগছে। কেন যে শালার বেটারা পছন্দ করে না আল্লাহ জানে। আমার মেয়ে কালো হতে পারে কিন্তু মুখের গড়ন কত মায়াবী। দেখিস একদিন এক রাজপুত্রের সাথেই তোর বিয়ে হবে। বলেই মা আমাকে ঘোমটা পরিয়ে দিলেন।
আমি এখন ছেলে পক্ষ এর সামনে বসে আছি। সবাই আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এ মুহূর্ত টা প্রতিটা মেয়ের জন্য যে কেমন অস্বস্তিকর তা কেবল মেয়েরাই বুঝতে পারে। মুরুব্বি টাইপের একজন জিজ্ঞেস করলো বলতো পোলাও রান্না করার সময় কতটুকু পানি দিতে হয়? আমি বললাম হাতের আঙ্গুল এর চার আঙ্গুল পরিমাণ পানি যেন চালের উপর থাকে।
মুরুব্বি বললেন, বাহ তুমি তো দেখছি খুব সংসারী মেয়ে। ওনার পাশে বসা দুইজন ভদ্রমহিলা কি যেন কানাকানি করছেন। আমি একবার দেখেই চোখ নামিয়ে ফেললাম। যেহেতু কানাকানি শুরু হয়ে গেছে তার মানে আজও ঘটনা খারাপ। কারণ বেশিরভাগ সময় ছেলের সাথে দেখতে আসা মহিলাগুলোই আমাকে অপছন্দ করে। কে জানে মেয়েরাই হয়ত মেয়েদের খুঁত বেশি ধরতে পারে।
এবার মুরুব্বি বললেন, বাবা নিজাম তুমি কি জিজ্ঞেস করবা কর। আমি একবার চোখ তুলে তাকে দেখে নিলাম। কি আশ্চর্য এ ছেলে তো দেখতে একেবারে রাজপুত্র! এবার আমি ১০০% নিশ্চিত এ ছেলেও আমাকে পছন্দ করবে না। এ ছেলে আমাকে বিয়ে করতে যাবে কোন দুঃখে? ঘটক বেটার উপর খুব রাগ হচ্ছে। কেন এমন গাছে আর মাছে বিয়ে আনে? সব বাবার থেকে টাকা খাওয়ার বুদ্ধি।
নিজের উপরো খুব রাগ হয় আমার। এস এস সি পাশ করার পর আর পড়া লেখা করিনি। বাবা আমার আর ছোট দুই বোনের পড়ার খরচ চালাতে পারবেনা জানি। তাই নিজে থেকেই পড়া ছেড়ে দিয়ে ছিলাম যেন বাবার কষ্ট না হয়। এখন খুব দুঃখ হচ্ছে পড়াশুনা করে আজ নিজে কিছুএকটা করতে পারতাম হয়তো। বিয়ে না হলেও বাবা মায়ের ঘাড়ের উপর বসে থাকতে হতো না। তারপরও একটা প্রশ্ন থাকে, মেয়েরা পড়াশুনা করে চাকরি বাকরি করলেই কি তাদের বাবা মায়ের তাদের জন্য বিয়ের টেনশন চলে যায়?
নিজাম একটু খুক খুক করে কেশে বলল, না চাচা আমি আর কি জিজ্ঞেস করবো। জানতাম সে এই কথাই বলবে। হয়ত আমাকে দেখে তার আর কিছু বলার ইচ্ছে টুকুও নেই। সে মনে হয় এখন এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে।
আমি এখন বাসর ঘরে বসে আছি। সব কিছুই স্বপ্নের মত লাগছে। প্রতিবার আমার বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পর আমি রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখতাম, আমার বিয়ে হচ্ছে। খুব সুন্দর করে সেজে একটু ফুলের সাজানো বিছানায় বসে আছি। ঘুম ভেঙ্গে গেলে কেন যেন খুব কষ্ট হতো। দু চোখের পানিতে বালিশটা ভিজে যেত মধ্য রাতে। এ চোখের পানি বিয়ে ভাঙ্গার জন্য নয়। বারে বারে নিজের কালো বর্ণের জন্য কিছু মানুষের কাছে রিজেক্ট হবার কষ্ট। যেন কালো হয়ে আমি কোন অন্যায় করেছি।
আমার সব ভাবনায় ছেদ পরল নিজামের কথায়।
কি হল কি ভাবছো? আমি ওর দিকে তাকালাম। বললাম, আপনি আমায় বিয়ে করেছেন কেন? আমি তো দেখতে অসুন্দর আর আপনি…আমি কথা শেষ করতে পারলাম না। নিজাম আমাকে থামিয়ে দিলো। বলল, আমার কাছে তো তুমি দেখতে অতুলনীয়। কালো আর সাদা বর্ন দিয়ে কি মানুষের সৌন্দর্য বিচার করা যায়? মানুষ তো কোন শোপিস বা পন্য নয় যে তাকে সুন্দর ই হতে হবে। তোমাকে আমার প্রথম দেখায় ভালো লেগেছে। তোমাকে দেখেই মনে হয়েছে তুমিই আমার জীবন সঙ্গী হবার যোগ্য। যে সুখ দুঃখে আমার পাশে থাকবে। বলো থাকবে পাশে? নিজামকে অনেক আপন লাগছে এখন। হুট করে নিজামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আর বললাম, থাকব পাশে। ওকে ধরেই হু হু করে কাঁদতে লাগলাম যেন অনেক দিনের জমানো কষ্টটা হালকা করছি।