তখন আমরা থাকতাম চট্টগ্রামের বন্দর কলোনিতে। কলোনির প্রায় প্রতিটি বাসা একতলা বিশিষ্ট। যদিও এখন সে কলোনি গুলো ভেঙ্গে বহুতল বিশিষ্ট বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে।বাসাগুলোর সামনের গেইট গুলো এমন যে বাইরে থেকে গেইটের ভিতর কেউ থাকলে তার শরীরের এক তৃতীয়াংশ দেখা যেত। ভিতর থেকেও সেইম।
২০০৭ সালের মে মাসের একটি রাত। অসম্ভব গরম আর গুমট আবহাওয়া ছিল।। আমি ৩ মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলাম। গরমে আমার জীবন যায় যায় অবস্থা। সন্ধ্যার পর দেখলাম বাইরে হঠাৎ গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছিল। তাই অপেক্ষা না করে দরজা খুলে বাইরে যাচ্ছিলাম। আমার হ্যাসবেন্ড ঘরেই ছিল। সে বলল আরে কর কি, এ সময়ে তুমি বাইরে যাচ্ছ কেন? এ সময়টা বাইরে যাওয়া ঠিক না। আমি বললাম একটু যাই গেইটের ভিতরই থাকবো। রাস্তায় যাবনা। একটু বৃষ্টিতে ভিজে আসি। বলেই তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘর থেকে বের হলাম। আমাদের ঘরের সামনের দরজা থেকে একেবারে গেইট পর্যন্ত ফুলের টব সারি সারি করে সাজানো ছিল। এ জন্য আমার এ জায়গাটা অনেক ভাল লাগতো। যাই হোক, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আমার মাথায় পরছিল আর আমি অন্য রকম এক ধরনের আনন্দে ভাসছিলাম। কিছুটা যেন প্রশান্তির ছোঁয়া লাগছিলো। বাইরের রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের আলোয় হঠা ৎ দেখলাম গেইটের বাইরে একটা বৃদ্ধ লোক মাথায় টুপি পরা আমাদের গেইটের কাছ থেকে আমাকে ডাকছে। আমি গেইটের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম কি ব্যাপার? উনি বললেন ওনার অনেক পানি পিপাসা পেয়েছে এক গ্লাস পানি দিতে পারব কিনা। লোকটিকে দেখে আমার কেমন যেন মায়া হল ভাবলাম যেহেতু টুপি মাথায় হয়ত নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েছেন, এখন গলা শুকিয়ে এসেছে বলে পানি চাচ্ছে। এখানে বলে রাখি সে সময় আমাদের বাসায় হ্যাসবেন্ডের বড় বোন তার পরিবার নিয়ে থাকতো। যেহেতু আমি বাসায় একা নই, লোকটিকে বললাম ঠিক আছে আপনি ভিতরে আসুন পানি দিচ্ছি। আমি ভিতর থেকে গেইট খুলে দিলাম। লোকটি কোন কিছু না বলে আমার পিছু পিছু আমাদের বসার ঘরে আসলো। আমি লোকটাকে বসতে বলার জন্য তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। ঘরের লাইটের আলোয় আমি যাকে দেখছি আর বাইরে যে ছিল মনে হচ্ছিল সে একরকম না। লোকটাকে অস্বাভাবিক লম্বা মনে হল।একটা হালকা খয়েরি রঙের কাবলি সুট পরা। সুটটি এতই পরিষ্কার মনে হচ্ছিল এখনি আলমারি থেকে ভাজ খুলে পড়ে এসেছে। তাছাড়া উনি শ্বেত রোগী।এ ধরনের লোক আমি এই প্রথম চোখের সামনে দেখে ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ালাম। আমি লোকটাকে বসতে বলেই আমার হ্যাসবেন্ডকে গিয়ে বললাম একটা লোক বাইরে থেকে পানি খেতে চেয়েছে আর আমি ঘরে এনে বসিয়েছি। সে খুব অবাক হয়ে বলল, পানি চেয়েছে সেটা তো বাইরে নিয়ে দিয়ে আসতে পারতে। অচেনা একটা লোককে ঘরে ঢুকাতে গেলে কেন? আমি বোকার মত ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম সত্যি তো অচেনা একটা লোককে এ সময়ে কেউ ঘরে ঢুকায় নাকি। সে বলল ঠিক আছে তুমি আপাকে দিয়ে পানি পাঠিয়ে লোকটাকে বিদায় করো আর আমরা আর কেউ যে ঘরে আছি সেটা ঐ লোককে বুঝতে দিবানা। আমি আমার ননাসের রুমে গিয়ে ওনাকে সব বললাম। উনি বলল ঠিক আছে চল আমরা দুই জনই একসাথে যাই। এবার পানি নিয়ে গিয়ে আমার ননাসও লোকটাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। লোকটাকে পানি দিয়ে বললেন, চাচা আপনাকে তো আর এ কলোনিতে কখনো দেখিনি, আপনি কি এখানে কারো বাসায় বেড়াতে এসেছেন? লোকটি একটু রহস্যময় ভাবে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, না মা আমি অনেক দূরের একটি দেশ থেকে এসেছি। ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওনাদের কথা শুনছিলাম। এমনিতেই অচেনা এক লোককে ঘরে ঢুকিয়েছি। সবার কত বকা যে আজ কপালে আছে সেটাই ভাবছিলাম। তার উপর লোকটির কথা গুলোও কেমন রহস্যময়। আমার ননাস যতই লোকটির কাছ থেকে ওনার পরিচয় নিতে চাচ্ছে লোকটি ততই নিজের পরিচয় এড়িয়ে যাচ্ছিলো। এবার তিনি লোকটিকে বললেন আচ্ছা আপনি কিছু খাবেন? লোকটি বলল না মা কিছু খাবনা। যে মেয়েটি আমাকে ঘরে ঢুকিয়েছে সে কে? ননাস বলল সে আমার ভাইয়ের বউ। দোয়া করবেন চাচা সে প্রেগন্যান্ট। আমার খুব রাগ হল তখন। অচেনা লোককে উনি আমার ইনফরমেশন দিচ্ছেন তাই। এবার আমার ননাসকে বলল যাও একটু তেল আর পানি নিয়ে আসো। তিনি তেল আর পানি নিয়ে আসলো। এবারো আমার রাগ লাগলো। একজন দোয়া চাইল আর একজন পানি পড়া দিয়ে দোয়া দিতে প্রস্তুত। বাঙ্গালি একেবারে হুজুর সাজায় উস্তাদ। উনি তেল আর পানি এনে দিলেন আর লোকটি কি যেন পড়ে ফুঁ দিতে লাগলো। ননাস এবার লোকটিকে নিজের ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কথা বলে দোয়া চাচ্ছিল। আমার কাছে কেমন নাটক নাটক ঠেকছিল সবকিছু। এবার লোকটা আমাকে কাছে ডাকল। আমিও গেলাম। লোকটাকে বিদায় করে দিতে পারলেই যেন বাঁচি এখন। আমি লোকটির কাছ থেকে প্রায় একহাত দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। লোকটি আমার হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে ফুঁ দিতে লাগলো। খেয়াল করলাম হাতগুলো অসম্ভব ঠাণ্ডা একেবারে বরফের মত। আমার খুব ভয় আর অস্বস্তি লাগছিলো। তাই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। এবার লোকটি বলল ঠিক আছে আমি তাহলে আসি এখন। বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। এখানে বলে রাখি এতক্ষণ এই লোক যা যা বলছিল আর করছিল সব কিছু আমার হ্যাসবেন্ড আর ননাসের হ্যাসবেন্ড আড়াল থেকে শুনছিল আর দেখছিল। ওনারা ধরেই নিয়েছিল এ লোকের কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু যখন দেখল লোকটি কোন রকম কিছু ক্ষতি করা ছাড়াই চলে গেছে, দুই জনই লোকটি ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে পিছু নিলো লোকটি কোথায় যায় দেখার জন্য। কিন্তু ওরা গেইটের কাছে যেতে না যেতে ঐ লোক উধাও। আমাদের গেইটের কাছ থেকে মেইন রোড বা অন্য রোড দিয়ে ঢুকলেও লোকটির প্রায় ২ থেকে ৩ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু মুহূর্তে সে গায়েব। ওরা দুইজন অনেকক্ষণ খোঁজা খুঁজি করেও লোকটাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ফিরে আসলো। তখন ঘরের সবারই লোকটি সম্পর্কে এক মত যে ঐ লোক মানুষ না অন্য কিছু। আমি সবার সাথে একমত হতে পারছিলাম না আবার লোকটির অদ্ভুত আচরণকে অস্বীকারও করতে পারছিলাম না। পরদিন সকালে কলোনির সব মসজিদে লোকটির সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হল । কিন্তু কেউই লোকটি সম্পর্কে কিছু বলতে পারেনি।
আজ অনেক বছর কেটে গেছে কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে আমার ঐ স্মৃতি মনে পড়ে। এখন পর্যন্ত ঐ ঘটনাটা কি সাধারণ একটি ঘটনা নাকি অলৌকিক কিছু আমি এর কোন ব্যাখ্যা পাই না।
মাকসুদা আইরিন