বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার সাহিত্য চর্চা পরিবর্তিত হয়ে আসছে। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়, অথবা আধুনিক বাংলা সাহিত্য বলতে সাহিত্যের যে অংশগুলো বুঝানো হয়ে থাকে সেগুলোর সাথে কয়েক যুগ আগের সাহিত্য চর্চার বিষয়ের পার্থক্য রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের এই ধারা প্রভাবিত হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের কিছু শক্তিমান সাহিত্যিকদের মাধ্যমে। দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে রচিত হচ্ছে বাংলা সাহিত্য ।তাই বাংলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি।এ সময়ে সৃষ্টি হয়েছে সুবিশাল এক সাহিত্য।নানা সময়ে নানা রূপ ধারণ করেছে সাহিত্য।কালে কালে নতুন হয়ে এগিয়েছে সাহিত্য।
হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যকে ভাগ করা হয় তিনটি যুগে যুগ তিনটি হচ্ছে:
প্রাচীন যুগ:৯৫০-১২০০ পর্যন্ত।
মধ্যযুগ:১৩৫০-১৮০০ পর্যন্ত।
আধুনিক যুগ:১৮০০ থেকে এখন পর্যন্ত,আরো বহুদিন পর্যন্ত।
প্রাচীন যুগ
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এ যুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন হল চর্যাপদ।
চর্যাপদ :চর্যাপদ হল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধনা সঙ্গীত।বৌদ্ধদের ধর্মতত্ব,দর্শনতত্ত্ব সাধন -ভজন প্রভৃতি কাব্যরূপ লাভ করেছে।মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের ‘রয়েল লাইব্রেরি ‘থেকে ১৯০৭ সালে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন।চর্যাপদের পদের সংখ্যা ছিল মোট ৫১ টি।এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে সাড়ে ৪৬ টি।জানা গেছে,১৯০৭ সালের আগে চর্যাপদের কোন ধারণা ছিল না।চর্যাপদের রচয়িতার সংখ্যা ছিল ২৪ জন মতান্তরে ২৩ জন।সব’চে বেশি চর্যাপদ রচনা করেন কাহ্নুপা /কাহ্নপা /কৃষ্ণপা।১৩ টি পদ রচনা করেন তিনি।চর্যাপদের আদি কবি হলেন লুইপা।সন্ধ্যা ভাষায় রচিত হয় চর্যাপদ। চর্যাপদ রচিত হয়েছিল মাত্রাবৃত্ত ছন্দে।চর্যাপদের রচয়িতাগণের মধ্যে কাহ্নপা-র ২৪ নং,তন্ত্রীপা ২৫ নং কুক্কুরীপা-র ৪৮ নং পদ পাওয়া যায় নি।ধারণা করা হয়,চর্যাপদের রচয়িতাগণের মধ্যে একমাত্র মহিলা ছিলেন কুক্কুরীপা।চর্যাপদ নামটি নিয়ে পন্ডিতগণের মতভেদ রয়েছে।কারো মতে,আশ্চর্যচর্যাচয়,সুকুমার সেনের মতে ,চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়, আধুনিক গণের মতে,চর্যাগীতিকোষ।তবে চর্যাপদ নামটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।
মধ্যযুগ
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এ ১২০১-১৮০০ সাল পর্যন্ত সময়কে বলা হয় মধ্যযুগ। তবে মধ্যযুগের কিছু কালিমা আছে।যার নাম অন্ধকার যুগ।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনঃ মধ্যযুগের প্রথম ও বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় নিদর্শন হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।শ্রীকৃষ্ণের। প্রেমে রাধা ও গোপীদের পাগলপ্রায় অবস্থা বর্ণিত হয়েছে এ গ্রন্হে।মূলত এই গ্রন্হে রাধা কৃষ্ণের অন্তরালে ইশ্বরের প্রতি জীবকুলের আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে।মধ্যযুগের প্রথম কবি বড়ু চণ্ডীদাস এটি রচনা করেন।
মঙ্গলকাব্যঃ মধ্যযুগে দেব দেবীর লীলামাহাত্ন্য নির্ভর করে যে শ্রেণীর কাব্য রচিত হয়, তাই মঙ্গল কাব্য।মঙ্গল কাব্যের প্রধান শাখা ৩ টি।মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল। এ কাব্যে প্রায় ৬২ জন কবির সন্ধান পাওয়া গেছে।
সাহিত্যে মুসলমানদের আবির্ভাবঃপ্রথম মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে এ যুগে।অনেক মুসলমান কবি বৈষ্ণবসাহিত্য রচনা করেন।তারা মূলত ঐতিহাসিক কাহীনি নিয়ে কাব্য রচনা করতেন।এ যুগের আরেকটি আবিষ্কার হল ইউসুফ-জুলেখা।কাব্যটির রচনা করেন সাহ মুহম্মদ সগীর।
মূলত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর ই শেষ হয় মধ্যযুগ। তাই তাকে বলা হয় যুগ সন্ধিক্ষণের কবি। তারপর উদিত হয় আধুনিক যুগের সূর্য! এই যুগের সাহত্যের প্রধান বৈশিষ্ট হল মানবতাদ, আত্মচেতনা এবং তার প্রসার। আগের সাহিত্যে মূলত দেব দেবীর স্তুতি গাওয়া হত। কিন্ত আধুনিক যুগ এই প্রথা ভেঙ্গে দেয়। জন্ম দেয় নতুন প্রথার। এই যুগেই আমরা পাই গল্প, উপন্যাস, রম্য, প্রবন্ধ ইত্যাদি। এর সুচনা করেন অনেকেই। তার মধ্যে প্রথম আর প্রধান হলেন উইলিয়াম কেরি। এজন্য বাঙ্গালী এই মহান মানুষকে মনে রাখবে আজীবন।
অন্ধকার যুগঃ
১২০১-১৩৫০ পর্যন্ত সময় অন্ধকার যুগ হিসেবে পরিচিত। এই ১৫০ বছর বাংলা সাহিত্যে লিখিত কোন সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায় নি।সমাজ ও জনজীবন নিয়ে মানুষ বিপর্যয় হওয়ায় সাহিত্য রচনায় আত্ননিয়োগ করতে পারে নি।
আধুনিক যুগ
১৮০১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময় হল আধুনিক যুগ।বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগে অনেক লেখকের সমৃদ্ধ লাভ করেছে।প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা গদ্যে কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি। মধ্যযুগে কিছু নিদর্শন পাওয়া গেলেও তা উল্লেগযোগ্য নয়।তাই বলা হয় বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটে উনিশ শতকে।বাংলা গদ্যের পথিকৃৎ হলেন ‘উইলিয়াম কেরি’।১৮০০ সালের ৪ঠা মে লর্ড ওয়েলেসলি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্টা করেন।এ কলেজ থেকেই বাংলা বিভাগ চালু করা হয় ১৮০১ সালে।
উল্লেখযোগ্য অনেকের নামই বলতে পারি তবে অন্যতম হলেন ঈশ্বরচন্দ্র নামের ভদ্রলোকের যিনি আবস্কার করেন বাংলা ভাষার ১২ টি বিরাম চিহ্নের। তার আগে বাংলা সাহিত্য কোন দাড়ি কমা ছিল না! শুধু ছিল এক দাড়ি আর দুই দাড়ি! তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। মানুষ খুশি হয়ে তার উপাধি দিলেন বিদ্যাসাগর।
তা দেখে কিছুটা মনে কষ্ট পেয়ে কপালকুণ্ডলা, দুর্গেশ নন্দিনি, বিষবৃক্ষ কিংবা কমলাকান্তের দপ্তরের মত কালজয়ী উপন্যাস প্রবন্ধ সৃষ্টি করেন বঙ্কিমচন্দ্র সাহেব। মানুষ দিলেন বাহবা!!! বিনিময়ে পেয়ে গেলেন সাহিত্য সম্রাট উপাধি! এটা দেখে রেগেমেগে বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মেঘনাদবদ এবং বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রচলন করলেন সনেটের সেই সাথে নাটকও। আরও সৃষ্টি করলেন প্রহসন! তার এতগুনে মুগ্ধ হয়ে এবার সবাই তাকে দিলেন বাংলা কাব্য সাহিত্যের আধুনিকতার জনক, আধুনিক বাংলা নাটকের জনক, বাংলা সাহিত্যর সনেটের প্রবর্তক। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তবে প্রথম উপন্যাস কিন্ত প্যারিচাদ মিত্র ই লেখেন যার নাম আলালের ঘরে দুলাল।
মধুসূদন এরপর আসেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এ সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তার নিপুন ছোঁয়া পড়েনি। তিনি একই সঙ্গে কবি, ঔপন্যাসিক, শিক্ষাবিদ, গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, অভিনেতা, ভাষাবিদ, গায়ক, নাট্যপ্রযোজক, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক! তাই তার সম্পর্কে কোন রকম আলোচনা এই আর্টিকেলে করতে চাইনা শুধু এতটুকু ই বলব রবী ঠাকুর মানেই একটি নাম একটি জগত! তার সাহিত্যের অনবদ্য অবদান স্বরূপ তিনি পান নোবেল পুরুস্কার! (গীতাঞ্জলী কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ – song offerings, ১৯১২)
মূলত বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের শাখাকে যে কয়জন টেনে নিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ৬ জন যেমন ১ ঠাকুর (রবিন্দ্রনাথ) ২ চট্টোপাধ্যায় (শরত, বঙ্কিম) আর ৩ বন্দ্যোপাধ্যায় (বিভুতি, মানিক, তারাশঙ্কর) উপন্যাসের জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে রবী ঠাকুরকেও যিনি ছাপিয়ে গেছেন তিনি শরত বাবু। সমাজের পোড় খাওয়া, নিগৃহীত, অবহেলিত মানুষদের প্রতিদিনের মনের কথা আর বাস্তব অথচ করুন চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাকে দেয়া হয় “বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পি” উপাধি।
তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্ত তার কাছাকাছিই ছিলেন। বিভূতি বাবুকে সবাই মনে রাখবে তার পথের প্যাচালি, আরণ্যক বা আদর্শ হিন্দু হোটেল প্রভৃতি সৃষ্টির জন্য। একইভাবে মানিক বাবুকে সবাই মনে রাখবে তার পুতুল নাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পুতুল নাচের ইতিকথা ইত্যাদির জন্য কিংবা তারাশঙ্কর বাবুকে সবাই চিনবে তার কবি, গনদেবতা, ধাত্রিদেবতার প্রভৃতি অমরসব সৃষ্টির জন্য।
মূলত বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতা যে কয়জন সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে ৫ জনের নাম সবার আগে থাকবে। তারা হলেন, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধিন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবতি।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এ এদের মধ্যে আবার অন্যতম হলেন জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতাই আগের সকল নিয়মকে ভেঙ্গে দেয়। রচনা করেন কবিতায় আধুনিক ধারা! রবী ঠাকুর তার কবিতাকে বলেছিলেন “চিত্ররুপময়” আর বুদ্ধদেব বলেছিলেন “নির্জনতম কবি” সাহিত্যবোদ্ধারা তাকে বলেন, “শুদ্ধতম কবি”
অপর দিকে যার কবিতায় শরীরের পশম দাড়াতে বাধ্য, কর্ণে ঝঙ্কার তুলতে বা রক্ত টগবগ করতে যার জুড়ি নেই, নিজেই ছিলেন বিদ্রোহী, মানুষের মনে বিদ্রোহ আনতে যার জুড়ি মেলাভার তিনিই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অল্পবয়সে তিনি বাকরুদ্ধ না হলে সৃষ্টি করে যেতেন অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান এর মত অনবদ্য সব সৃষ্টি! তারমত না হলেও বাংলার আরেক নক্ষত্র মাত্র ২১ বছর বয়সেই পরপারে চলে যান। তিনি কবি সুকান্ত!
আরেকজন মানুষ কিন্ত পুরো লেখার আর ভাষার রীতিকেই ঢেলে সাজান। চালু করেন চলিত রীতি! তিনি প্রমথ চৌধুরী। অন্যদিকে হাস্যরসাত্মক সাহিত্যে নারায়ণ কিংবা প্রেমেন্দ্র মিত্রকে সবাই ই মনে রাখবে যথাক্রমে তাদের টেনিদা আর ঘনাদার জন্য।
আর অতি সম্প্রতির উদাহরন দিলে যেই কিছু নাম চলে আসবে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সমরেশ মজুমদার, সুনীল আর হুমায়ূন আহমেদ! বলা যায় বর্তমান জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে এরা তুঙ্গে আছেন।
হুমায়ূন আহমেদ এদিক দিয়ে কিছুটা এগিয়ে আছেন কারন তিনি বাংলাদেশী মানুষদের পশ্চিম বাংলা বিমুখ করতে একাই লড়েছেন এবং সফলও হয়েছিলেন। তিনি নতুন ধারা সৃষ্টি করেন আর সেটি হল সংলাপ প্রধান সাহিত্য! তার কালজয়ী সৃষ্টি হিমু, মিসির আলী, শুভ্র বাংলাদেশী পাঠকদের মনে যে গেথে থাকবে বছরের পর বছর তার প্রমান একটু চোখ খুললেই দেখা যায়।
পরিশেষে আবারও ক্ষমাপ্রাথি এজন্য যে, এত ছোট আর্টিকেলে বাদ রয়ে গেছে অনেকেরই নাম। (নিরমলেন্দু গুন, মীর মোশাররফ, আবু ইসহাক, জহির রায়হান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রভৃতি নক্ষতের নাম) তথ্য প্রদানেও থাকতে পারে ভুল। এই ভুল ধরিয়ে দিলে থাকব কৃতজ্ঞ হয়ে।