আসুন আরও একবার ঘন হইয়া বসিয়া এই বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলের পাললিক অববাহিকার মানবকুলের ক্রেতা বিক্রেতা কিমবা বাজার ঘাট লইয়া একখানা যুতসই আলোচনা করিয়া লইঃ

লিখিবার শুরুতেই বলিয়া লই আমি, আপনি,আমরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কিমবা গিন্নির চাপে,তাপে পড়িয়া হইলেও মার্কেট বা বিপনি বিতানে যাইতে হয়। ভুলিয়া যাইবেন না যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই জামানায় মানুষ নিজেও পণ্য হইয়া গিয়াছে।

আসুন কাঁচা বাজারে প্রবেশ করিয়া উহার খোঁজ খবর লইয়া লই। কিছু মানুষকে দেখিবেন তাহারা সবজি কিনিতে যাইয়া লাউ ক্রয় করিবার সময় সাধের লাউ কচি কিনা বা নরম কিনা তাহা পরীক্ষা করিতে যাইয়া লাউ এর উপর দেখিবেন তাহার নখ দিয়া এমন জোরে চাপ কিমবা চিমটি কাটিবেন যে উহা রীতিমতো সুয়েজ খাল বানাইয়া ফেলিবেন এবং বিক্রেতা বিরক্ত হইয়া বলিবেন লাউ না কিনিয়া বালিশ একখানা কিনিয়া লইয়া যান উহা বেশ নরম হইবে। আর দয়া করিয়া আমার দোকানের সামনে হইতে সরিয়া যান আমার অন্য কাস্টমার নষ্ট হইতেছে। ইহার পর উনি যাইবেন মাছ কিনিতে। যাইয়াই উনি খোঁজা আরম্ভ করিয়া দিবেন যে,দেশি মাছ আছে কিনা?উহা পরীক্ষা করিবার জন্য উনি মাছের কানশা ধরিয়া টানাটানি করিবেন। মাছের গায়ের রঙ পরীক্ষা করিবেন অতঃপর শুরু করিবেন এই মাছ বঙ্গীয় কোন অঞ্চল হইতে আনা হইয়াছে। তাহার পর শুরু করিবেন মাছ লইয়া দামাদামি, উনি রীতিমত রাবারের ন্যায় দাম লইয়া টানাটানি করিয়া অবশেষে বিক্রেতা বলিয়া বসিবেন এই দামে মাছ না বাজার হইতে কিছু মাছের পোনা ক্রয় করিয়া লইয়া যান আর উহা বেশি করিয়া পিয়াজ মরিচ দিয়া ভুনা করিয়া খান।

আসুন দেখি এইবার বড় বড় শপিংমলে একটু ঘুরিয়া আসি এই যেমন ধরুন “ ঝসুনধরা শপিং মল” কিমবা “কমুনা ফিউচার পার্ক”। ইহাতে বিক্রেতাগনের নিকট আপনি মোটামুটি জামাই আদর পাইবেন যাহা আপনি নিজ শ্বশুরালয়েও পাননি এবং যাহা লইয়া মাঝে মাঝেই আপনার প্রিয়তমা গিন্নিকে খোঁচা দিয়া থাকেন। প্রস্তুত হইয়া যান এইখানে আপনার পকেটের নিরাপত্তা আপনাকেই লইতে হইবে। কারন গিন্নি যখন শাড়ি একখান ধরিয়া বসিবেন তো বিক্রেতা সাথে সাথেই বলিয়া বসিবেন ম্যাডাম আপনার পছন্দের প্রসংশা না করিয়া পাড়িতেছিনা,এই শাড়িতে আপনাকে অসাধারণ লাগিতেছে। অনেকের নিকটই বিক্রয় করিয়াছি কিন্তু কাউকেই এত সুন্দর লাগে নাই। স্যার কে জিজ্ঞাসা করুন আপনাকে দেখিতে কেমন সুন্দর লাগিতেছে?স্যারের কি আর এত সাহস রহিয়াছে যে,বলিবেন তোমাকে সুন্দর লাগিতেছেনা। উনি তো উনার সকল সাহস উনার আপিসের অধস্তনদের দেখাইয়া দৌড়ের উপর রাখেন কিন্তু স্বীয় স্ত্রীর নিকট তো উনি বিড়াল জাতীয় প্রাণীর ন্যায় মিউ মিউ। তো স্যার আর কি বলিবেন? যাহা বলিলে উনার প্রান রক্ষা হয় তাহাই বলিবেন জি আজ্ঞে তোমাকে আসলেই সুন্দর লাগিতেছে। বিক্রেতা তৎক্ষণাৎ বলিয়া বসিবেন আরেক সেলসম্যানকে,এই শাড়িটা ম্যাডামের জন্য প্যাকেট কর। আর বলিবেন, এই সবুর তাড়াতাড়ি স্যার আর ম্যাডামের জন্য দুই মগ কফি লইয়া আসো। এইবার যখন দাম জিজ্ঞাসা করিবেন তখন বিক্রেতা বলিবেন আপনি আমার বিসমিল্লাহ কাস্টমার অর্থাৎ বউনি কাস্টমার আপনার সহিত আবার দামাদামি কিসের একদম ক্রয়মূল্যে আপনাকে দিয়া দিয়াছি, মাত্র বিশ হাজার টাকা। আমি,আপনি কলুর বলদ এসির মধ্যে ঘামা শুরু করিয়া দিব। অজ্ঞত্তা কি আর করা মানিব্যাগ কিমবা “ফ্রেডিট কার্ড” দিয়া কিনিয়া স্ত্রীর হাসিমুখ নিশ্চিত করিয়া নিজের উচ্চরক্তচাপ আরও বৃদ্ধি করিয়া গৃহে ফিরিয়া আসিব। আপনার গিন্নি হাসিমাখা মুখে আপনার দিকে তাকাইয়া বলিবেন আসলেই অনেক কমে কিনিতে পাড়িয়াছি। পাশের বাসার ভাবি এইরুপ একখান শাড়ি পঁচিশ হাজার টাকায় কিনিয়াছেন।

এইবার আসুন একটু মোবাইল মার্কেট হইতে ঘুরিয়া আসি। ইদানিং দেখিবেন স্মার্ট ফোন প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীগন স্মার্ট ফোন হইতেও অধিক স্মার্ট এবং বেশ মিষ্টভাষী হইয়া থাকেন। আপনি দোকানে প্রবেশ করিবার সাথে সাথেই উহারা আপনার নিকট চলিয়া আসিয়া সালাম সহকারে আপনার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করিয়া দিবেন। আপনাকে বিভিন্ন মডেলের মোবাইলসেট দেখাইবেন এবং উহার নিত্য নতুন ফিচার যাহা আপনি ক্রয় করিবার পর আগামী দুই বৎসরেও একবারের জন্যও ব্যাবহার করিবেন না কিন্তু দেখিবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহারা আপনার মগজের নিয়ন্ত্রন নিজ মগজে লইয়া লইয়াছেন এবং আপনি যেই বাজেট লইয়া মোবাইল সেট ক্রয় করিতে গিয়াছিলেন তাহার হইতেও অধিক মূল্যের একখানা মোবাইল সেট ক্রয় করিয়া লইয়া আসিয়াছেন।

মোবাইল সেট ক্রয় করিবার পর আপনি যাইবেন ইহার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যাহাকে বিক্রেতাগণ এক্সেসরিস বলিয়া থাকেন। প্রথমেই দেখা মিলিবে স্ক্রীন প্রটেকটরের বিক্রেতার সহিত। তাহারা আপনার সেটের মূল্য দেখিয়াই বুঝিয়া ফেলিবেন আপনার সামর্থ্য কোন পর্যায়ের, এর পর বলিবেন স্যার এত দামি মোবাইল কিনিয়াছেন ইহার জন্য ভাল প্রটেকটর ব্যাবহার করিতে হইবে। আমার নিকট হাতুড়ি প্রুফ প্রটেকটর রহিয়াছে, যদিও দামখানা একটু বেশি হইবে। আপনি যখন জানিতে চাহিবেন হাতুড়ি প্রুফ মানে কি? তিনি উত্তর দিবেন স্যার ইহা লাগাইলে সেট হাত হইতে পড়িয়া গেলেও সেটের কিছুই হইবে না। আপনি চাহিলে হাতুড়ি দিয়া বারি দিয়া দেখিতে পারেন তবুও ইহা ভাঙ্গিবে না। বিক্রেতা আরও বলিবেন স্যার আজকে মনের ভুলে বাসা হইতে আসিবার সময় হাতুড়িখানা আনা হয় নাহি, নচেৎ হাতুড়ি দিয়া বাড়ি দিয়া দেখাইতাম এই প্রটেকটর কি জিনিষ। আপনি মুগ্ধ হইয়া যাইবেন তাহার এই সকল প্রমানে এবং তৎক্ষণাৎ অতি চড়া মূল্যে উহা লাগাইয়া নিবেন কারন আপনার আগের সেটখানি নিজ হস্ত হইতে পড়িয়া গিয়া দুই টুকরা হইয়া গিয়াছিল। অথচ পরের দিন আপিসে আসিয়া দেখিবেন আপনার সহকর্মীও একি সেট ক্রয় করিয়াছেন এবং গুলিস্থানের পাতাল মার্কেট হইতে মাত্র দুইশত টাকায় একি প্রটেকটর লাগাইয়া আনিয়াছেন আর আপনার নিকট এই একি হাতুড়িপ্রুফ প্রটেকটরের দাম বিক্রেতা লইয়াছেন মাত্র দুইহাজার টাকা।

বিদ্রঃ জগৎ যতদিন থাকিবে এই ক্রেতা বিক্রেতার খেলা ততদিন চলিতেই থাকিবে। আপনি ঠকিবেন না ঠকাইবেন উহা আপনার নীতি নৈতিকতার উপর নির্ভর করিবে। ভুলিয়া যাইবেন না যে, এই পুঁজিবাদী অর্থনীতি আপনাকে আমাকে সত্য বলিতে খুব একটা উৎসাহ না দিয়া বরঞ্চ মিথ্যার বেসাতি করিতে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করিয়া থাকে। তবুও বলিতেছি আসুন ক্রয় বিক্রয় যাহাই হউক না কেন অধিক মুনাফা অথবা কোনও কিছু ক্রয় করিবার সময় অধিক জিতিয়া যাইবার এই প্রবনতা পরিত্যাগ করাই স্রেও।